ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে ১৫৭টিরও বেশি বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করা হয়। এসবের বিপরীতে পরিশোধিত পৌনে ৪ লাখ কোটি টাকার বিলসহ যাবতীয় নথি তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। নথিপত্রে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা দেখানো হয়েছে ২৩ হাজার ৫৮৪ মেগাওয়াট।
সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর ঘুষ গ্রহণ, স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে প্রকল্প পাস করানো, সরকারি জমি দখল এবং ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানে ওইসব নথি তলব করে সংস্থাটি।
গত ৬ মে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিউবো) চেয়ারম্যানের কাছে নথিগুলো তলব করেন অনুসন্ধান দলের প্রধান ও দুদকের উপপরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন।
এ বিষয়ে গতকাল দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম জানান, দুদক থেকে চিঠি দিয়ে যেসব নথিপত্র চাওয়া হয়েছে, সেগুলো তারা সরবরাহ করছে। বিদ্যুৎ সেক্টরে অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি তদন্তের জন্য এসব নথি নেওয়া হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জের নামে চলেছে হরিলুট। বিনা টেন্ডারে দায়মুক্তি আইন বা বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০ করে আওয়ামী লীগ সমর্থক ব্যবসায়ীদের উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। সরকারের তিন মেয়াদে বিদ্যুৎ খাতে মোট ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৮৩০ কোটি ডলার। টাকার হিসাবে এর পরিমাণ প্রায় পৌনে ৪ লাখ কোটি টাকা। শুধু ক্যাপাসিটি চার্জের নামেই আত্মসাৎ হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকা। অন্যদিকে বিদ্যুৎ খাতের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ক্রয়, ভূমি অধিগ্রহণ এবং রক্ষণাবেক্ষণে ভয়াবহ অনিয়ম ও লুটপাট হয়েছে। বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ সক্ষমতায় ব্যবহার করা হবে- এমন শর্তে লাইসেন্স দেওয়া হয়। কিন্তু এসব কেন্দ্র চলেছে গড়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। কেন্দ্রগুলো বছরের ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে অলস বসে ছিল। প্রয়োজন না থাকলেও অতিরিক্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়। উচ্চমূল্যের এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে বছরের পর বছর ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের পকেটে ঢোকে।
সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের আগে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরপত্রের মাধ্যমে ৮ কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়। বিনা দরপত্রে ৩২টি কুইক রেন্টাল কেন্দ্র নির্মাণ করে। দরপত্র এড়াতে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে দুই বছরের জন্য পাস করা হয় জরুরি বিশেষ আইন। পরে আইনটির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে সর্বশেষ ২০২৬ সাল পর্যন্ত করা হয়। এই আইনের অধীনে ৭২টি রেন্টাল ও ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) কেন্দ্রের অনুমতি দেওয়া হয়। বিনা দরপত্রে প্রতিযোগিতা ছাড়াই এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বড় অংশই পেয়েছেন তৎকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে সামিট, ওরিয়ন, দেশ এনার্জি, ডরিন পাওয়ার, ইউনাইটেড এবং এনার্জিপ্যাক। বিনা দরপত্রে বিদ্যুৎ কেন্দ্র পাওয়ার শীর্ষে ছিল সামিট গ্রুপ। সামিটের সাতটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভাড়া পেয়েছে ১ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। দ্বিতীয় স্থানে আছে ইউনাইটেড গ্রুপের পাঁচটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, তারা পেয়েছে ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। কনফিডেন্স গ্রুপ বিনা দরপত্রে পেয়েছে ছয়টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। তারা পেয়েছে ৯৬২ কোটি টাকা। কেন্দ্র ভাড়া পাওয়ার ক্ষেত্রে পঞ্চম স্থানে আছে বাংলাক্যাটের চারটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ষষ্ঠ নামটি সিঙ্গাপুরভিত্তিক সেম্বকর্পের। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এপিআর এনার্জি পেয়েছে ৬৮০ কোটি টাকা। নবম স্থানে ছিল ডরিন গ্রুপের ছয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র। দশম স্থানে দেশ এনার্জির চার বিদ্যুৎ কেন্দ্র, তারা নিয়েছে ৫১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ডরিন পাওয়ারের মালিক ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত নূরে আলম সিদ্দিকীর ছেলে ও ঝিনাইদহ থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়া তাহজীব আলম সিদ্দিকী। দেশ এনার্জি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের। দুদক বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চালু করা ১৫৭টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নথি তলব করা হয়েছে। চিঠিতে বিউবোর সঙ্গে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সম্পাদিত চুক্তি, পাওয়ার পারচেস এগ্রিমেন্ট, ইম্পিলিমেন্টেশন এগ্রিমেন্টসহ সব চুক্তির নথি চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর অনুকূলে পরিশোধ করার যাবতীয় বিল ও বকেয়া বিল সংক্রান্ত নথিসহ অন্যান্য যাবতীয় নথি চাওয়া হয়েছে। দুদকের চিঠিতে ভারতের বাহারামপুর থেকে ১ হাজার মেগাওয়াট ও ত্রিপুরা থেকে ১৬০ মেগাওয়াট ও ঝাড়খণ্ডে আদানি পাওয়ার থেকে ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির নথিও সংগ্রহ করা হয়েছে।