সবকিছু ঠিক থাকলে আজ বিকালে হতে যাচ্ছে সময়ের সবচেয়ে আলোচিত জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায়। স্বাক্ষর অনুষ্ঠান জাঁকজমক করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও জুলাই সনদ নিয়ে এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি বলে দাবি রাজনৈতিক দলগুলোর। এদিকে তৃতীয় দফায় বাড়ানো হলো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ।
জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূস, উপদেষ্টা পরিষদের অন্যান্য সদস্য, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিসহ কূটনীতিক, গণমাধ্যমকর্মী ও সমাজের নানা স্তরের ব্যক্তি উপস্থিত থাকবেন। কমিশনের পক্ষ থেকে গতকাল রাতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে গিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এর আগে সংসদ সচিবালয়ে আয়োজনের বিস্তারিত জানিয়ে কমিশন ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সেখানে বলা হয়, অনুষ্ঠানকে বর্ণাঢ্য করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে কমিশন তাদের সুপারিশ সরকারকে জানাবে বলে জানানো হয়। জুলাই সনদ নিয়ে এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি বলে দাবি করা রাজনৈতিক দলগুলোর ভাষ্য, রাষ্ট্র সংস্কার ইস্যুতে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। রয়েছে অনেক অমীমাংসিত ইস্যু। এসবের সমাধান না করেই সনদ স্বাক্ষর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের কোনো পথরেখা এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। গণভোটে দলগুলো একমত হলেও কীসের ভিত্তিতে গণভোট হবে, গণভোটে কী কী বিষয় থাকবে এবং গণভোট কখন হবে মোটা দাগে এই তিন বিষয় নিয়ে পরিষ্কার করে কিছু জানানো হয়নি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে।
জুলাই জাতীয় সনদের অঙ্গীকারনামার দ্বিতীয় দফায় বলা হয়েছে- ‘এই সনদের সকল বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরণ নিশ্চিত করবো এবং বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনও আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সেই ক্ষেত্রে এই সনদের বিধান/প্রস্তাব/সুপারিশ প্রাধান্য পাবে।’ এটাকে অনেকে ব্যাখ্যা করছেন জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য দেওয়া হিসেবে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- জুলাই সনদ হচ্ছে রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল। কোনো সমঝোতা দলিলকে ‘সংবিধানের ঊর্ধ্বে’ অবস্থান দেওয়া যায় না। সেটা করা হলে খারাপ নজির তৈরি হবে। অঙ্গীকারনামার চতুর্থ দফায় বলা হয়েছে, ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর প্রতিটি বিধান, প্রস্তাব ও সুপারিশ সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে বলবৎ হিসেবে গণ্য হবে বিধায় এর বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এটাকে অনেকেই বলছেন, সংবিধানে নাগরিকদের দেওয়া মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন হিসেবে। কিন্তু জুলাই সনদ নিয়ে বৈধতার প্রশ্ন তোলা যাবে না এমনটা কেন বলছে ঐকমত্য কমিশন? রাজনৈতিক দলগুলোর এমন প্রশ্নেরও উত্তর মেলেনি বলে দাবি তাদের। নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তিসহ অনেক বিষয় কমিশন ঐকমত্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে এ নিয়ে আপত্তি জানানো হয়। তাদের যুক্তি-আপত্তিতে কীভাবে ঐকমত্য হতে পারে? আপত্তি ছাড়া বিষয়গুলোকেই ঐকমত্য হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। কিন্তু এ প্রশ্ন ও দাবির কোনো উত্তর দেওয়া হয়নি কমিশনের পক্ষ থেকে। সংবিধানে থাকা রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি নিয়ে কমিশন পুরো আলোচনা করেনি বলে অভিযোগ তুলেছে কয়েকটি দল। চার মূলনীতি নিয়ে কমিশন তাদের নিজেদের অবস্থানকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। মোটা দাগে এ নিয়ে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেন কমিশন এ ভূমিকা নিয়েছে সে প্রশ্ন করা হলেও উত্তর মেলেনি। দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় শেষের দুই দিন পর শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের যে বিধান সংবিধানের ৪-ক ধারায় সন্নিবেশিত হয়েছে তা বিলুপ্ত করা হবে কি হবে না তা নিয়ে মতামত চাওয়া হয়। এ নিয়েও প্রশ্ন্ তোলা হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, কমিশন মনে করে জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়া প্রয়োজন। এ জন্য কমিশনের মেয়াদকালে বাস্তবায়নের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা দেবে কমিশন। জুলাই আন্দোলন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে পরবর্তী সংস্কার ও রাজনৈতিক সনদ প্রক্রিয়ায় এনসিপির অবদান আছে, এদিক থেকে কমিশন আশা করছে এনসিপি জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে আসবে এবং সই করবে। কমিশন আশা করছে, শুক্রবার উৎসবমুখর পরিবেশে সই করবে রাজনৈতিক দলগুলো। তবে কোনো দল যদি মনে করে তারা পরে সই করবে সেটাও করতে পারে। তাদের জন্য দরজা খোলা থাকবে।
তৃতীয় দফায় বাড়ল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ : তৃতীয়বারের মতো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ বাড়িয়েছে সরকার। গতকাল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে কমিশনের মেয়াদ ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এর আগে গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সাত সদস্যের এ কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনকে ছয় মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, যার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল গত ১৫ আগস্ট। তবে কমিশনের কার্যক্রম সম্পন্ন না হওয়ায় এর আগে দুই দফায় মেয়াদ এক মাস করে বাড়ানো হয়। এবার তৃতীয় দফায় আরও ১৫ দিন মেয়াদ বাড়িয়েছে সরকার।
ড্রোন ওড়াতে নিষেধাজ্ঞা : জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ড্রোন ওড়ানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, শুক্রবার জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হবে। সংসদ এলাকায় এ সময় কোনো ধরনের ড্রোন ওড়ানো যাবে না। নির্দেশনা মেনে চলার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করা হলো।