বৃহস্পতিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

কোভিড-১৯: এন্টিবডি শুধু সুরক্ষাই দেয়?

ড. আসিফ আহমেদ

কোভিড-১৯: এন্টিবডি শুধু সুরক্ষাই দেয়?

জীবাণু সংক্রমণ হলে আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা নানাভাবে তা ঠেকাতে চেষ্টা করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত নাম এন্টিবডি। এন্টিবডি সাধারণভাবে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াকে পরাজিত করে শরীরের সুস্থতা নিশ্চিত করে এবং দীর্ঘমেয়াদে শরীরকে সুরক্ষিত রাখে। এন্টিবডির আরও কিছু ব্যবহার রয়েছে যেমন ওষুধ হিসেবে এবং শনাক্তকরণের কিটে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে। কোনো কোনো সময়ে এই এন্টিবডি শরীরে রোগ বৃদ্ধির কারণও হয়ে যায়।

এন্টিবডি কী : আমাদের শরীরকে রোগজীবাণু এবং বাইরের বিষাক্ত যেকোন উপাদান থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য শরীরে প্রতিরক্ষা বাহিনী সম্মিলিতভাবে কাজ করে। এটাকে ইমিউন সিস্টেম বা প্রতিরোধক ব্যবস্থা বলা হয়। শরীরে যখন কোনো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা অন্য ক্ষতিকর কিছু প্রবেশ করে তখন দেহের একাধিক কোষ বাইরে থেকে আসা এই শত্রুকে শনাক্ত করে, শত্রুকে চেনার জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো বৈশিষ্ট অন্য কোষের কাছে তুলে ধরে এবং এর ধারাবাহিকতায় এন্টিবডি তৈরি হয়। সাধারনভাবে বাইরে থেকে আসা ভাইরাস ব্যাকটেরিয়াকে শরীর বহিরাগত হিসেবে দেখে এবং এদের এন্টিজেন বলা হয়। এই এন্টিজেনের যে অংশগুলো অনন্য বৈশিষ্টের সেগুলোকে এন্টিজেনের এপিটোপ  বলা হয়। এপিটোপ সাধারণত ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার বাইরের অংশে বের হয়ে থাকা প্রোটিন হয়ে থাকে। এন্টিবডি কিছুটা ইংরেজি ওয়াই (Y) অক্ষরের মতো দেখতে প্রোটিন মলিকিউল। যা আকারে একটা ব্যাকটেরিয়া থেকেও অনেকগুন ছোট। ওয়াই এর দুই মাথা, যাদেরকে Fab বলে তারা এন্টিজেনের এপিটোপের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। আর নিচের অংশটি যার নাম Fc সেটি অন্য কোষের গায়ে যুক্ত হতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, কভিড-১৯ ভাইরাসের বাইরে অনেকগুলো করোনা বা কাঁটার মতো অংশ আছে (স্পাইক প্রোটিন), যেটা দিয়ে ভাইরাসটি আমাদের ফুসফুসের কোষে যুক্ত হয় এবং ভিতরে প্রবেশ করে। আমাদের প্রতিরোধক ব্যবস্থা এই স্পাইকগুলোকে এপিটোপ হিসেবে শনাক্ত করে এবং এমন এন্টিবডি বানায় যা সব সময় ঐ স্পাইক দেখলে আটকে ধরতে পারবে। অর্থাৎ ঐ এন্টিবডিগুলো কভিড-১৯ এর অনন্য বৈশিষ্ট্য স্পাইক দেখে আলাদা করে চিনবে এবং তার সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে। একটি ভাইরাসের বাইরে নানা রকমের এপিটোপ থাকতে পারে। তাই ভাইরাস সংক্রমণ হওয়ার পর শরীরে যে এন্টিবডিগুলো তৈরি হয় তা ভাইরাসটির অনেকগুলো এপিটোপকে শনাক্ত করতে পারে। এরকম এন্টিবডির মিশ্রণ যারা ভাইরাসের একাধিক এপিটোপ শনাক্ত করতে পারে তাদের পলিক্লোনাল এন্টিবডি বলে। এর বিপরীতে যেসব এন্টিবডি কেবল একটি এপিটোপকেই চিনতে পারে তাদের মনোক্লোনাল এন্টিবডি বলে।

শরীরে ভাইরাস ঢুকলে এন্টিবডি কীভাবে কাজ করে : শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণের শুরুর দিকে অন্যান্য প্রতিরোধক কোষ ভাইরাসকে মেরে ফেলতে চেষ্টা করে এবং সপ্তাখানেকের ভিতর শরীরে পলিক্লোনাল এন্টিবডি তৈরি হয়ে যায়। এই পলিক্লোনাল এন্টিবডি আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে কয়েক বছর পর্যন্ত অবস্থান করে যা একই ভাইরাসের পুনঃআক্রমণ হলে দ্রুত ভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এন্টিবডি দুইভাবে শরীরে ভাইরাসকে মোকাবিলা করে। (১) এন্টিবডিগুলো ভাইরাসের এপিটোপগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয় এবং ঘিরে ধরে, ফলে ভাইরাস মানবদেহের কোষের গায়ে যুক্ত হতে পারে না, এভাবে ভাইরাসগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তাই এ ধরনের এন্টিবডিকে নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি (neutralizing antibody) বা নিস্ক্রিয়কারী এন্টিবডি বলা হয়। (২) এন্টিবডি ভাইরাসকে সরাসরি নিষ্ক্রিয় করে না, বরং প্রতিরোধ ব্যবস্থার অন্য কোষের কাছে খবর পৌঁছে দেয় এবং তারাই ভাইরাসটিকে ধ্বংস করে ফেলে। ব্যাপারটা অনেকটা আসামিকে গ্রেফতার বা অবস্থান শনাক্ত করে অন্য সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার মতো। এই এন্টিবডিগুলোকে নন-নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি বা বাইন্ডিং এন্টিবডি বলে।

এন্টিবডি ক্ষতির কারণ যখন : কিছু কিছু ভাইরাসের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, ভাইরাসকে শরীরে নিষ্ক্রিয় করার বদলে এন্টিবডি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাইরাসকে মানব শরীরের কোষে প্রবেশে সাহায্য করে যার ফলে ভাইরাসের সংক্রমণ আরও গতি পায়। এটাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় এন্টিবডি ডিপেন্ডেন্ট এনহান্সমেন্ট (ADE) অর্থাৎ এন্টিবডির মাধ্যমে সংক্রমণ বৃদ্ধি। ADE কীভাবে ঘটে সেটা পুরোপুরি না জানা গেলেও বেশ কিছু সম্ভাব্য কারণ বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করেছেন। গবেষকরা এই ঘটনাটি ডেঙ্গু, ইনফ্লুয়েঞ্জা, এইচআইভি, ইবোলা এবং করোনাভাইরাসে ঘটতে দেখেছেন। উদাহরণ হিসেবে ডেঙ্গু ভাইরাসের কথা বলা যায়। ডেঙ্গু ভাইরাসের বেশ কিছু সেরোটাইপ আছে, অর্থাৎ সেরোটাইপগুলোর এপিটোপে কিছু পার্থক্য থাকে তাই তাদের সংক্রমণে যে এন্টিবডি তৈরি হয় তাতে ভিন্নতা থাকে। কোনো ব্যক্তিকে যখন প্রথম কোনো একটি সেরোটাইপ ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণ করে তখন এর বিপরীতে এন্টিবডি তৈরি হয়ে শরীরে থাকে। পরে কোনো সময় যদি ঐ একই ব্যক্তি অন্য কোনো সেরোটাইপের ডেঙ্গু দ্বারা আক্রান্ত হন তাহলে আগের তৈরি হওয়া এন্টিবডি পুরোপুরিভাবে এই ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে না। তখন এ এন্টিবডিই ভাইরাসকে উল্টো শরীরে প্রবেশ করিয়ে সংক্রমণ বৃদ্ধি করে এবং এ কারণেই দ্বিতীয় সংক্রমণে রোগীর জটিলতা এবং মৃত্যুর সম্ভাবনা বেড়ে যায়। 

কভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে ADE কেন গুরুত্বপূর্ন : একদল গবেষক মার্স ভাইরাসের ক্ষেত্রে ADE নিয়ে গবেষণা করে জার্নাল অব ভাইরোলজিতে বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন (১)?। ল্যাবে আলাদাভাবে কালচার করা মানব কোষে নিউট্রালাইজিং মনোক্লোনাল এন্টিবডি দিয়ে তারা দেখেছেন এ ভাইরাসের ক্ষেত্রে ADE ঘটে। তবে ডেঙ্গুর মতো সেরোটাইপ আলাদা না হয়েও এটি ঘটতে পারে। অর্থাৎ একই এন্টিবডি যা ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে তা আবার পরিস্থিতি ভেদে ভাইরাসকে মানবকোষের ভিতরে প্রবেশে সাহায্যও করতে পারে। তারা এটিও দেখিয়েছেন এন্টিবডি ভাইরাসের স্পাইকের যেখানে যুক্ত হয়, মানবকোষের রিসেপ্টর ও একই জায়গাতে যুক্ত হয়। অর্থাৎ এন্টিবডি ADE করার ক্ষেত্রে কেবল একটা মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। তারা আরও দেখান যে এন্টিবডির পরিমাণ বাড়িয়ে দিলে ADE কমতে থাকে। অর্থাৎ অল্প এন্টিবডি পরিপূর্ণভাবে ভাইরাস নিষ্ক্রিয় করতে পারে না এবং সেই  ক্ষেত্রে ভাইরাসকে মানবকোষে প্রবেশ করিয়ে দেয়। তবে এ ব্যাপারে আরও ভালোভাবে নিশ্চিত হতে অন্য প্রাণী এবং মানুষে আরও গবেষণা প্রয়োজন।

অন্যান্য ভাইরাসে ADE ঘটার প্রেক্ষিতে কানাডার একজন গবেষকও মনে করছেন হয়তো কভিড-১৯ এর অধিক সংক্রমণের ক্ষেত্রে ADE এর কোনো ভূমিকা থাকার সম্ভাবনা আছে (২)?। কারণ মানবদেহে মৃদুরোগ সৃষ্টিকারী চার রকমের করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে, সেই সঙ্গে সার্স ও মার্স এর সংক্রমণে মানুষের শরীরে এন্টিবডি তৈরি হয়ে থাকছে। ডেঙ্গুর মতো হয়তো কভিড-১৯ সংক্রমণের পর আগে থেকে শরীরে থাকা এন্টিবডিগুলো ADE এর মাধ্যমে সংক্রমণ আরও ভয়াবহ করে তুলছে। সার্স এবং কভিড-১৯ এর দুটি স্পাইক এপিটোপ তুলনা করে দেখা গেছে তাতে ৭২.৭% এবং ১০০% মিল রয়েছে। অর্থাৎ এ মিল না থাকা এপিটোপের জন ADE ঘটে থাকতে পারে। যেহেতু ভাইরাস খুব দ্রুত নিজেকে মিউটেশন করে পালটে ফেলতে সক্ষম, তাই বাইরের স্পাইক প্রোটিনের গঠনও পালটে যায়। বিজ্ঞানীরা ভ্যাক্সিন বানানোর সময় এই স্পাইক প্রোটিনকে ফোকাস করেন।

ফলে বিজ্ঞানীরা সাবধানতার সঙ্গে ভ্যাকসিন না বানালে, ভ্যাকসিন শরীরে যে এন্টিবডি তৈরি করবে তা পরবর্তীতে পাল্টে যাওয়া ভাইরাসের সংক্রমণে ADE ঘটাতে পারে।

সূত্র : 1. Wan Y, Shang J, Sun S, Tai W, Chen J, Geng Q, et al. Molecular Mechanism for Antibody-Dependent Enhan-cement of Coronavirus Entry. J Virol. 2019; 2. Tetro JA. Is COVID-19 receiving ADE from other corona viruses? Microbes Infect. 2020;

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক,

বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটকি ইঞ্জিনিয়ারিং, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর