দেশে মৃত্যুর শীর্ষ কারণগুলোর অন্যতম হৃদরোগ ও রক্তনালির রোগ। কিন্তু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, অবকাঠামো এবং অর্থসংকটের কারণে সঠিক চিকিৎসার অভাবে প্রতি বছর দুই লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারায় হৃদরোগে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর হার কমানোসহ রোগীর বিদেশ যাওয়া ঠেকাতে একগুচ্ছ পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্টেন্টের দাম কমানো, নতুন করে কিছু ক্যাথেটারাইজেশন ল্যাব (ক্যাথল্যাব) স্থাপন, বন্ধ থাকা ক্যাথল্যাব চালু করা, কয়েকটি হাসপাতালে করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন হাসপাতালে কার্ডিওলজিস্টের পদ সৃষ্টি, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে হৃদরোগ চিকিৎসার ডিভাইসের নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুত করার জন্য কাজ করছে সরকার। এসব পদক্ষেপের আওতায় চিকিৎসার খরচ কমানোর পাশাপাশি ঢাকার বাইরে বেশ কিছু জেলায় হৃদরোগের চিকিৎসাসেবার ব্যাপ্তি বাড়ানো হবে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমানের সভাপতিত্বে এক সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘কয়েক মাস ধরেই হৃদরোগীদের চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার প্রবণতা কমেছে। দেশের হাসপাতালগুলো রোগীদের এই বাড়তি চাপ সামাল দিতে সক্ষম হচ্ছে। কোনো হৃদরোগী চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন না। এখন স্টেন্টের মূল্যও একটি যৌক্তিক পর্যায়ে আনা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘হৃদরোগের চিকিৎসায় কোথায় কী সমস্যা আছে, তা চিহ্নিত করেছি আমরা। ঢাকার বাইরে চিকিৎসাসেবা বাড়ানোর বিষয়ে আমরা অগ্রাধিকার দেওয়ার চেষ্টা করব, যাতে রোগীদের ঢাকায় আসতে না হয়।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে দেশের বিপুলসংখ্যক হৃদরোগী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কার্ডিয়াক সার্জন সোসাইটির তথ্যমতে, দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ৪২টি কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিট রয়েছে, যার মধ্যে ৩২টিতে কার্ডিওভাসকুলার সার্জারি করার ব্যবস্থা আছে। বর্তমানে মাত্র তিনটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কার্ডিয়াক সার্জারি হয়। সিলেট, রংপুর, খুলনায় ক্যাথল্যাব আছে সেখানে এনজিওগ্রাম হয়, কিন্তু সার্জারি হয় না। প্রতিবছর দেশে ১০-১২ হাজার কার্ডিয়াক সার্জারি হয়। কিন্তু সার্জারির প্রয়োজন প্রায় ২৫ হাজার। হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য ক্যাথল্যাব অত্যন্ত জরুরি। এ ল্যাবে এনজিওগ্রাম, এনজিওপ্লাস্টি, পেসমেকার বা আইসিডি ইমপ্লান্টেশনসহ বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়। সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ৮৭টি ক্যাথল্যাব রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে স্থাপন করা হয়েছে ৫৮টি। দক্ষ জনবলের অভাবে সারা দেশে পড়ে আছে আটটি ক্যাথল্যাব। ঢাকায়ও অনেক হাসপাতালে ক্যাথল্যাবে যন্ত্র অচল।
পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সোসাইটির (পিসিএসবি) তথ্যমতে, দেশে প্রায় ৪ লাখ শিশু বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগে ভুগছে। প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার শিশু জন্মগতভাবে হৃদরোগ নিয়ে জন্ম নেয়। প্রতিবছর হৃদরোগে আক্রান্ত প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু চিকিৎসার অভাবে মারা যায়। পিসিএসবির সহসভাপতি এবং জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের শিশু হৃদরোগ বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুস সালাম বলেন, দেশে শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা ৩০ জনের বেশি নয়। তাদের প্রায় সবাই ঢাকায় চিকিৎসাসেবা দেন। জরুরি সেবার অভাবে বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে আরও একটি ক্যাথলাব স্থাপন করা হবে। এই হাসপাতালে এখন সাতটি ক্যাথল্যাব রয়েছে, কিন্তু সবগুলো সবসময় কার্যকর থাকে না। ফরিদপুর, টাঙ্গাইল ও মানিকগঞ্জ হাসপাতালে ক্যাথল্যাব স্থাপন করা হলেও ব্যবহার শুরু হয়নি। দ্রুত এসব ক্যাথল্যাব চালু করার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) স্থাপন করা হবে। পাশাপাশি বগুড়া, রাজশাহী ও দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হৃদরোগের চিকিৎসা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ ছাড়া ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে স্টেন্টের (হার্ট রিং) গড় মূল্য ও বাংলাদেশের কর কাঠামো পর্যালোচনা করে দেশে স্টেন্টের নতুন দাম নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সভায়। কম দামি স্টেন্টের ক্ষেত্রে এই পার্থক্য খুব বেশি না। কিন্তু ১ লাখ টাকার বেশি দামের স্টেন্টের ক্ষেত্রে পার্থক্য অনেক। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, বর্তমানের তুলনায় অন্তত ৫ হাজার টাকা হলেও দাম কমানোর কথা ভাবছে সরকার।