জীবন রক্ষাকারী অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারে বাড়ছে প্রাণনাশের ঝুঁকি। অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে পড়ছে। আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে-এখন লোকালয়েও পাওয়া যাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া। চিকিৎসকদের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে এক সময় অ্যান্টিবায়োটিক সাধারণ সর্দি-জ্বরেও কাজ করবে না। তখন সামান্য অসুখ-বিসুখেই প্রাণ হারাতে হবে।
আইসিডিডিআরবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় এর ভয়াবহতা উঠে এলেও নেওয়া হচ্ছে না কার্যকর ব্যবস্থা। আইসিডিডিআরবির ইনফেকশন ডিজিজ ডিভিশনের অ্যাসিসট্যান্ট সায়েন্টিস্ট ডা. গাজী মো. সালাউদ্দিন মামুন বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে-আইসিইউতে ভর্তি হওয়া রোগীরা যেসব ব্যাকটেরিয়া দিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছেন। যেমন সরকারি হাসপাতালে বহুল ব্যবহৃত সেফট্রায়াক্সন এখন মাত্র ৮ শতাংশ আইসিইউ রোগীদের ক্ষেত্রে কার্যকর। মেরোপেনেমের মতো শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসকরা রোগীদের সর্বশেষ পর্যায়ে ব্যবহার করার জন্য রেখে দেন। এটার অপব্যবহারের ফলে আইসিইউয়ের রোগীদের ইনফেকশনের ক্ষেত্রে এখন কাজ করছে মাত্র ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোনো দেশে যেখানে প্রথম পর্যায় বা অ্যাক্সেস গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করার কথা ৬০ শতাংশ, সেখানে আমাদের দেশে দ্বিতীয় পর্যায় বা ওয়াচ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি ৬৩ শতাংশ। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে শিশুদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হচ্ছে। যদিও শিশুদের অনেক রোগই ভাইরাসবাহিত, যা অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়াই ভালো হয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়াগুলো প্রধানত হাসপাতালে থাকে-এই ধারণাও এখন ভুল প্রমাণিত করে লোকালয়েও পাওয়া গেছে তাদের অস্তিত্ব। হাসপাতালের সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তি, এমনকি সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুরাও এগুলো বহন করে নিয়ে আসছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। এসব মারাত্মক জীবাণু খুব সহজেই আক্রান্ত করতে পারে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকা পরিবারের বয়ষ্ক ও শিশুদের। হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগী ও নবজাতকদের শরীরেও ছড়িয়ে পড়ছে এসব অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম মেনে হাত ধোয়া ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমেই এর বিস্তার কমানো সম্ভব বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে আইসিডিডিআরবির গবেষণার মাধ্যমে। বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. ফজলে রাব্বি চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কিছু অ্যান্টিবায়োটিক আছে যেগুলোকে একেবারে শেষ ধাপ হিসেবে রিজার্ভ করে রাখা হয়েছে। সে বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, একান্ত বিপদে না পড়লে এই রিজার্ভ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিকগুলো একেবারেই ব্যবহার করা উচিত নয়। কিন্তু বর্তমানে আমরা দেখছি অহরহ এসব রিজার্ভ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে। যেগুলো সাধারণত সর্বোচ্চ মুমূর্ষু অবস্থায় আইসিইউতে থাকা রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার হওয়া উচিত, সেগুলো এখন হাসপাতালে সাধারণ ওয়ার্ডেই ব্যবহার করতে হচ্ছে। গবাদি পশুর ফার্মে অ্যান্টিবায়োটিকের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার বিপদ আরও বাড়াচ্ছে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষক ড. লুৎফুল কবীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ভয়াবহ আকারে বাড়ছে। অসাধু চিকিৎসকরা অনেক সময় একাধিক ওষুধ কোম্পানিকে খুশি করতে একই রকমের বিভিন্ন কোম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন। ওষুধের দোকারদাররাও নিজেদের ইচ্ছা মতো প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করছেন। রোগীরাও অসচেতনতার কারণে অ্যান্টিবায়োটিকের ডোজ সম্পন্ন করছেন না।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, আমরা রিজার্ভের যে অ্যান্টিবায়োটিকগুলো এখনই ব্যবহার করে ফেলছি, এর পরে কিন্তু আমাদের আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তখন দেখা যাবে অ্যান্টিবায়োটিক সাধারণ সর্দি-জ্বরে কাজ করবে না। সামান্য অসুখ-বিসুখেই আমাদের প্রাণ হারাতে হবে।’