শিক্ষাবিদ ড. আমিনুল ইসলাম গড়ে তুলেছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মাস্টার মিশন। শিক্ষা ছড়াতে গড়ে তুলেছেন স্কুল, পাশাপাশি মিলছে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও অর্থ সহায়তা...
জামবাড়ি। ভারত সীমান্তবর্তী কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার একটি গ্রাম। এই গ্রামে ২৫ বছর আগে কোনো হাই স্কুল ছিল না। ভাঙা রাস্তায় তিন কিলোমিটার হেঁটে শিক্ষার্থীদের যেতে হতো ফকির বাজার কিংবা দুই কিলোমিটার দূরের আমড়াতলী স্কুলে। এতে অনেকে স্কুলে যেত না। যারা স্কুলে যেত তাদের অধিকাংশ ঝরে যেত। বিষয়টি নাড়া দেয় ওই গ্রামের সন্তান প্রফেসর ড. আমিনুল ইসলামকে। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। তার পিতা ছিলেন স্কুলশিক্ষক তমিজ উদ্দিন মাস্টার। গ্রামবাসীকে নিয়ে তিনি বসেন। সবাইকে নিয়ে বসে পিতার নামে প্রতিষ্ঠা করেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মাস্টার মিশন। যার লক্ষ্য সুশিক্ষা, সুস্বাস্থ্য ও মানবকল্যাণ। শিক্ষার প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় বদলাতে থাকে জামবাড়ি, ইলাশপুর, বাঁশমঙ্গল, আমড়াতলীর একাংশ ও কোটেশ্বরসহ বিভিন্ন গ্রামের শিক্ষাব্যবস্থা। স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠান করতে প্রথমে প্রফেসর ড. আমিনুল ইসলাম কোটি টাকার জমি দান করেন। নিজে ও এলাকাবাসীর সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা করেন মাস্টার মিশন শিশু বিদ্যালয়। সঙ্গে কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্যও জমি দান করেন। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মাস্টার মিশন বিদ্যালয় (উচ্চ বিদ্যালয়)। প্রফেসর ড. আমিনুল ইসলাম বার্ধক্যে আক্রান্ত হওয়ায় তার স্বজন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ ইজাজুল হকসহ অন্যরা দায়িত্ব
নেন। শিক্ষার সঙ্গে সংগঠন থেকে প্রতি মাসে ৫৫ জন দুস্থ মানুষকে দেন নগদ সহায়তা দেওয়া হয়। প্রায় প্রতি সপ্তাহে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। গড়ে তোলা হয়েছে মাস্টার মিশন এতিমখানা। এছাড়া বিভিন্ন উৎসব ও শীতে কাপড়, খাবার ও অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়। সরজমিন দেখা যায়, সবুজ মাঠের পাশে স্নিগ্ধ পরিবেশে গড়ে উঠে মাস্টার মিশনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। মাঠে পিটি ও শপথ বাক্য পাঠ করছে শিক্ষার্থীরা। তাদের মধ্যে মেয়ে শিক্ষার্থীই বেশি। পাশে প্রফেসর ড. আমিনুল ইসলামের বাড়ি। সেখানে কেউ থাকেন না। বাড়ির একটা অংশকে মাস্টার মিশনের অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেখানে প্রতি মাসের প্রথম শুক্রবার দেওয়া হয় অর্থ সহায়তা। প্রায় প্রতি শুক্রবার দেওয়া হয় বিনামূল্যে চিকিৎসা। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম, সাদিয়া আক্তার ও দশম শ্রেণির সাকিমুন ইসলাম তন্বী বলেন, ‘দূরের স্কুলে গেলে আমাদের যাতায়াত ভাড়া বেশি লাগত। এছাড়া টিফিন কিনে খেতে হতো। গ্রামে স্কুল হওয়ায় আমাদের খরচ কমেছে। এছাড়া দরিদ্র শিক্ষার্থীদের এখানে কম বেতনে পড়ানো হয়। এছাড়া গ্রামে স্কুল হওয়ায় শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার কমেছে।’ মাস্টার মিশন সংগঠনের উপকারভোগী কোটেশ্বর গ্রামের মাজেদা বেগম, কোটেশ্বর গ্রামের জামাল মিয়া ও দক্ষিণ জামবাড়ির ছাদেক মিয়া বলেন, ‘কারও পরিবারে আয় কম, কেউ অসুস্থ তাই তেমন কাজ করতে পারেন না। এখানে তারা ভাতা ও বিনামূল্যে চিকিৎসা পেয়েছেন। এতে তাদের উপকার হয়েছে।’ স্থানীয় বাসিন্দা সাহেদ হোসেন বলেন, ‘এখানে স্কুল প্রতিষ্ঠা হওয়ায় এলাকায় শিক্ষার হার বেড়েছে। এখানে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিনাবেতন ও হাফ বেতনে পড়তে দেওয়া হয়। এছাড়া বই-খাতার জোগান দেওয়া হয়। বিনামূল্যে চিকিৎসা ও অর্থ সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে।’ মাস্টার মিশন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ ফয়েজুল হক বলেন, ‘শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে প্রফেসর ড. আমিনুল ইসলাম মাস্টার মিশন বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। প্রতিষ্ঠানগুলো জামবাড়িসহ আশপাশের গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে।’ মাস্টার মিশন বিদ্যালয়ের সভাপতি প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ ইজাজুল হক বলেন, ‘প্রফেসর ড. আমিনুল ইসলাম গ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি মানুষের পাশে দাঁড়াতে পছন্দ করতেন। তিনি সে কাজগুলো নিয়মিত করতে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মাস্টার মিশন গঠন করেন। এই গ্রামসহ আশপাশের মানুষ বিশ্বাস করেন তাদের কল্যাণে প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলা হয়েছে। তাই তারা বিভিন্নভাবে সহযেগিতা করেন। গ্রামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়ায় নারী শিক্ষার হার বেড়েছে। ঝরে পড়ার হার কমেছে এবং কমেছে বাল্যবিয়ে।