বাংলাদেশের ব্যাংক খাত গত কয়েক বছরে ঋণ পরিচালনায় যে দুর্বলতা প্রদর্শন করেছে, তা শুধু আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতাকেই নয়, বরং সাধারণ মানুষের ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি আস্থাকেও গভীরভাবে নড়বড়ে করেছে। বিধিনিষেধের শিথিল বাস্তবায়ন, ঋণ প্রদানে গুরুতর অনিয়ম, রেকর্ড পরিমাণ খেলাপি ঋণ, দুর্বল শাসন কাঠামো এবং কার্যকরী ও বণ্টনমূলক কর্মদক্ষতার অবনতি এসব মিলিয়ে এক জটিল সংকট তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক ভেদে পরিস্থিতি ভিন্ন হলেও সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাত দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রত্যাশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ঋণের গুণমান বজায় রাখতে পারেনি।
দেশে কার্যরত তফসিলি ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম পর্যালোচনা করে এসব তথ্য তুলে ধরেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) গবেষক দল। গতকাল রাজধানীর মিরপুরে বিআইবিএমের সম্মেলন কক্ষে ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম পর্যালোচনা-২০২৪ অনুুষ্ঠানে এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালে ব্যক্তিখাতে দেওয়া অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ বাংলাদেশের জিডিপির মাত্র ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ একই সময়ে চীনে এই হার ১৯৪ দশমিক ২ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ১১৬ দশমিক ১ শতাংশ, ভিয়েতনামে ১২৫ শতাংশ এবং ভারতে ৫০ দশমিক ১ শতাংশ। দেশের ৬২টি তফসিলি ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করলেও এ হার উন্নত অর্থনীতির তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থনীতিতে টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে মানসম্মত ও সুষম ঋণ বিতরণ অপরিহার্য, কিন্তু বাংলাদেশে তা হয়নি। এ ছাড়া, ব্যক্তি, লিঙ্গ, ব্যবসায়িক গোষ্ঠী, খাত ও ভৌগোলিক অঞ্চলের ভিত্তিতে ঋণ বণ্টনের চিত্রও অত্যন্ত অপ্রতিসম। এতে বহু উদ্যোক্তা ও উৎপাদনশীল খাত পর্যাপ্ত অর্থায়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো খেলাপি ঋণের লাগামহীন বৃদ্ধি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে রেকর্ড ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে মাত্র ১০টি ব্যাংকে কেন্দ্রীভূত রয়েছে প্রায় ৩ লাখ ২৮ কোটি টাকা, যা ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি। অর্থনীতিবিদদের মতে, এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে শুধু ব্যাংকিং খাত নয়, সামগ্রিক অর্থনীতিই মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে। সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি বেশ কিছু শক্তিশালী সংস্কার উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, পরিচালনা পর্ষদের পুনর্গঠন; বৈশ্বিক ঋণ শ্রেণিবিন্যাস মানে ফিরে যাওয়া; ‘আলটিমেট বেনিফিশিয়াল ওনার’ প্রবর্তন; ২০২৫ সালের ব্যাংক রেজোলিউশন অধ্যাদেশ প্রণয়ন; ঝুঁকিভিত্তিক তত্ত্বাবধান চালুর পরিকল্পনা ও ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড-৯ বাস্তবায়ন। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশেষভাবে, বিদ্যমান ঋণের গুণমান পুনঃস্থাপনে বাংলাদেশ ব্যাংক দ্বিমুখী কৌশল নিয়েছে। প্রথমত, ব্যাংকের সম্পদের গুণমান নিয়ে ব্যাপক পর্যালোচনা; দ্বিতীয়ত, দেশ ও বিদেশ উভয় স্থান থেকেই চুরি হওয়া সম্পদ উদ্ধারে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন।