উগ্রপন্থা উস্কে দেয়ার অন্যতম অবলম্বন ‘টুইটার’-এ নিষিদ্ধ হওয়ায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতিভ্রম চরমে উঠেছে। ফেসবুক-সহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যম আগেই নিষিদ্ধ করেছে ট্রাম্পকে। শুক্রবার রাতে এ নিয়ে প্রচন্ড উষ্মা প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। জনরোষের আতংকে অথবা বিজ্ঞাপণ-মার্কেট হারানোর শংকায় তার একান্ত অনুগত টিভিগুলোও যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে অবশিষ্ট ১১ দিন তিনি কীভাবে বিচরণ করবেন কট্টর সমর্থকদের মাঝে-এ নিয়ে নানা মন্তব্য করেছেন ট্রাম্প তার অবশিষ্ট সহচরদের কাছে।
সোমবার কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের ট্রাম্পকে ইমপিচমেন্টের বিল উঠবে। এটি চূড়ান্ত। বুধবারের মধ্যে তা পাশও হবে। একইসাথে অবিশ্বাস্য ঘটনার অবতারণা হতে পারে ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান-শাসিত ইউএস সিনেটেও। ভোটের কথা মাথায় রেখে অর্থাৎ জনসমর্থন ধরে রাখার স্বার্থেই হয়তো শেষ পর্যন্ত সিনেটও ইমপিচমেন্টের বিল পাশ করতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। কংগ্রেসে নির্বাচনী ফলাফল সার্টিফাই করার ক্ষেত্রে সিনেট লিডার মিচ ম্যাককনেল যে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়েছেন একইভাবে ‘ট্রাম্পকে অবাক’ করে দিয়ে হোয়াইট হাউজ থেকে তাকে অপসারণের বিলও বিপুল ভোটে পাশ হতে পারে বুধবার রাতেই।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে গৃহিত শপথ ভঙ্গ করে জনগণকে উস্কে দেন ট্রাম্প এবং বুধবার প্রকাশ্য সমাবেশ থেকে ক্যাপিটল হিলে হামলার নগ্ন আহবানের পরই উগ্রপন্থি হিসেবে পরিচিতরা ক্যাপিটল হিলে জঙ্গি হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে তছনছ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার গুরুতর অভিযোগের পাশাপাশি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণকে হত্যার চেষ্টা চালানোর অভিযোগও আসতে পারে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। ইতিমধ্যেই এফবিআইসহ বিভিন্ন সংস্থা সেভাবেই তদন্তে নেমেছে বলে জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ২০ জানুয়ারি জো বাইডেন শপথ গ্রহণের পর ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ক্রাইমে লিপ্ত থাকার মামলা শুরু হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ট্রাম্প দায়মুক্তি পাবেন না। ইমপিচমেন্টের বিল যদি উভয় কক্ষে পাশ হতে পারে তাহলে ‘দায় মুক্তি’র প্রশ্ন আর উঠবে না বলেও সংশ্লিষ্টরা উল্লেখ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখতে এবং ‘আন্তর্জাতিক মুরুব্বী’ হিসেবে নিজের অবস্থান অক্ষুণ্ণ রাখতেই এমন পদক্ষেপ নিতে হবে মার্কিন প্রশাসনকে-এমন মতামতও দিচ্ছেন আইনবিদরা।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বুধবারের ন্যাক্কারজনক অবিশ্বাস্য-অকল্পনীয় ‘প্রেসিডেন্টের মদদে জঙ্গি হামলা’র পর রিপাবলিকান পার্টির সমর্থকরাও উভয়-সংকটে পড়েছেন। অনেক নির্বাচিত প্রতিনিধিও সরে পড়ার কথা ভাবছেন। অথবা বিকল্প নেতৃত্বে ‘সত্যিকারের গণতন্ত্রী’রা জড়ো হবার চেষ্টায় রয়েছেন। কেউ কেউ ইতিমধ্যেই রিপাবলিকান পার্টি ত্যাগের ঘোষণাও দিয়েছেন। এর অন্যতম হলেন সিনেটর লিসা মারকুউস্কি। তিনি আলাস্কা থেকে রিপাবলিকানপার্টির ইউএস সিনেটর। তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন যে ট্রাম্পকে অবিলম্বে যে কোন পদক্ষেপের সাথে থাকবেন। কারণ, রিপাবলিকান পার্টিকে তিনি সর্বনাশ করেছেন। নেব্রাস্কার সিনেটর বেঞ্জামিন এরিক স্যাসেও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ট্রাম্পের সন্ত্রাসী আচরণের। এর আগেই ট্রাম্পের মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন ইউএস সিনেটে রিপাবলিকান লিডার মিচ ম্যাকনেলের স্ত্রী ইলেইন চাও। তিনি ছিলেন পরিবহন মন্ত্রী। বলা যেতে পারে বিড়ালের গলায় ঘণ্টি তিনিই প্রথম বাজিয়েছেন। যেভাবে ইলেক্টরাল কলেজ ভোটের ফলাফলে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন মিচ ম্যাককনেল আর ভাইস প্রেসিডেন্ট মাউক পেন্স। বর্তমানে ট্রাম্পের চারপাশে একান্ত অনুগতদের খুবই ছোট একটি দল রয়েছে, যাদের কোথাও যাবার সুযোগ নেই। এরা হলেন ডিজিটাল পরিচালক ডান স্ক্যাভিনিরো, প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত কার্যালয়ের পরিচালক জন ম্যাকএনটি, বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো, বক্তৃতালেখক স্টিফেন মিলার এবং ব্যক্তিগত আইনজীবী নিউইয়র্ক সিটির সাবেক মেয়র রুডি জুলিয়ানি।
ট্রাম্পের সন্ত্রাসী আচরণ আর স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের প্রতিবাদে ইতিমধ্যেই পদত্যাগের ঘোষণাকারির মধ্যে আরো রছেন শিক্ষামন্ত্রী বেটসি ডেভোস, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে ট্রাম্পের বিশেষ দূত মিক মুলভ্যানি, ডেপুটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি এডভাইজার ম্যাথিউ পটিঙ্গার, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সহকারি মন্ত্রী জন কস্টেলো, ইকনোমিক কাউন্সিলর টাইলের গুডস্পিড, ফার্স্টলেডির চীফ অব স্টাফ স্টিফানি গ্রিশম্যান, বিশেষ সচিব রিকি নিকেটা, ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি সারাহ ম্যাথিউজ। জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের আরো ৫ শীর্ষ কর্মকর্তাও পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন বলে শুক্রবার সর্বশেষ সংবাদে জানা গেছে। এরমধ্যে রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা সম্পর্কিত সিনিয়র এডভাইজার রব গ্রিনওয়ে, গণ-বিধ্বংসী এবং বায়ো-ডিফেন্সের সিনিয়র এডভাইজার এ্যান্থনী রুগিয়েরো, ইউরোপ ও রাশিয়া সম্পর্কিত সিনিয়র ডিরেক্টর রায়ান টুলি. প্রতিরক্ষা নীতির সিনিয়র ডিরেক্টর মার্ক ভ্যানড্রফ এবং আফ্রিকা সম্পর্কিত সিনিয়র ডিরেক্টর ইরিন ওয়ালশ।
হোয়াইট হাউজ ত্যাগের পথে থাকা অপর কর্মকর্তারা ভাবছেন যে, ট্রাম্পকে অপসারণের পর সংবিধান অনুযায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স দায়িত্ব নেবেন এবং তিনিই জো বাইডেনের কাছে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী দায়িত্ব হস্তান্তর করতে পারবেন। এ ব্যাপারটি আঁচ করতে পেরে কদিন থেকে পেন্সের সাথে কোন কথাই বলছেন না ট্রাম্প-হোয়াইট হাউজের সূত্রে মার্কিন গণমাধ্যমে এসেছে এ তথ্য। ইতিমধ্যেই মাইক পেন্সের ভূমিকাকে ‘ট্রাম্প-সমর্থকদের মধ্যে যারা সত্যিকারের গণতন্ত্রী’ তারা প্রশংসা করেছেন। নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সূচারুরূপের পালন করেছেন বলেই ইলেক্টরাল কলেজ ভোট গণনায় বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি ভাইস প্রেসিডেন্ট-এমন সপ্রশংস মন্তব্যও করেছেন কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা। অর্থাৎ ট্রাম্পকে বিদায়ের পর নতুন কোন পরিস্থিতির বিন্দুমাত্র আশংকা নেই মার্কিন রাজনীতিতে পট পরিবর্তনের। এমনকি রিপাবলিকান পার্টিও মাইক পেন্সকে ঘিরেই ভবিষ্যতে সুসংগঠিত হতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ট্রাম্পের উগ্রপন্থি সমর্থকরা আরো জঙ্গিরুপে ১৯ জানুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসিতে জড়ো হবার তৎপরতা চালাচ্ছে। তারা জো বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠানের সময় তুমুল কান্ড ঘটাতে চায় বলে বিভিন্নভাবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এ অবস্থা শক্তহাতে প্রতিহত করতে ১২ হাজারেরও অধিক পুলিশসহ ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করা হবে বলে ওয়াশিংটন ডিসি প্রশাসন জানায়। ইতিমধ্যেই নিউইয়র্কের গভর্ণর ন্যাশনাল গার্ডের একহাজার সদস্যকে ডিসিতে পাঠানোর কথা বলেছেন। এভাবে আশপাশের স্টেট থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর লোকজন সেখানে গিয়ে যে কোন ধরনের ‘ট্রাম্পিজন’ মোকাবেলা করার সংকল্প নিয়েছে।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল