ক্লোরোফর্ম। এটি রাসায়নিক পদার্থ। মানুষকে অজ্ঞান কিংবা বিভিন্ন গাছ-গাছড়া থেকে নির্যাস বের করতে ব্যবহার করা হয় ক্লোরোফর্ম। কিন্তু এই রাসায়নিক পদার্থ বিক্রিতে নেই কোনো মনিটরিং। যে কারণে খোলাবাজারে হামেশাই চলে বেচাকেনা। আর এই সুযোগটি নিচ্ছে কিছু অসাধু চক্র ও অজ্ঞান পার্টির সদস্য। যার অপব্যবহারের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক এই প্রতিবেদককে জানান, ক্লোরোফর্মে মিষ্টি এক ধরনের ঘ্রাণ আছে। এটি যে কারও নাকে ধরা হলে অজ্ঞান হয়ে পড়বেন। আর যদি পরিমাণে বেশি হয় তাহলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে থাকে। এত কিছুর পরও অবাধে খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে ক্লোরোফর্ম। যে কেউ মিটফোর্ড কিংবা হাটখোলা গেলে তা কিনতে পারবেন। এভাবে খোলাবাজারে বিক্রি করা চরম বিপজ্জনক। ফলে অনিরাপদ হয়ে পড়ছে মানুষের জীবন। দ্রুত মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি মনিটরিং না থাকায় অতিদাহ্য রাসায়নিকও বিক্রি হচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছে।
সর্বশেষ ১৩ অক্টোবর রাজধানীর উত্তরায় অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে কবির হোসেন (৪২) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। ওইদিন বিমানবন্দর থানার এসআই শেখ জাহিদুল ইসলাম মুন্না জানান, ৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় ওই ব্যক্তিকে উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরের রাস্তার পাশ থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পরে তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
পুরান ঢাকার আরমানিটোলার আরমানিয়ান প্লাজা, রাকিব কেমিক্যাল মার্কেট, প্রত্যাশী প্লাজা ও নূরজাহান প্লাজায় অন্যান্য রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের সঙ্গে অবাধে বিক্রি হয় ক্লোরোফর্ম। কথা হয় ১ নম্বর আরমানিয়ান স্ট্রিটের কেমিক্যাল কর্নারের এক কর্মচারীর সঙ্গে। তিনি জানান, তারা বিভিন্ন কারখানা ও ল্যাবরেটরি মালিকের কাছে ক্লোরোফর্ম বিক্রি করেন। প্রতি কেজিতে ১৫০ টাকা দাম নেন। জানা গেছে, ছাড়পত্রের ঘোষণায় কারসাজির মাধ্যমে দামি রাসায়নিক আমদানি করে প্রতি বছর ১০০ থেকে ২০০ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। অনেক সময় একটি ছাড়পত্র দিয়ে একাধিক চালান খালাস করা হয়। সিঙ্গাপুর, চীন, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসব রাসায়নিক আমদানি হয়। সরেজমিন দেখা গেছে, রাসায়নিকের একটি দোকান ঘেঁষে আরেকটি দোকান না থাকার নিয়ম থাকলেও তা মানছেন না কেউ। ক্যালসিয়াম কার্বাইড সাধারণের কাছে বিক্রি নিষিদ্ধ থাকলেও গোপনে ঠিকই বিক্রি হচ্ছে। উড ও বুটপলিশ দাহ্য পদার্থ হলেও তা বিক্রি হয় পাড়া-মহল্লার হার্ডওয়্যারের দোকানেও। থিনার, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, অ্যাসিটোন, জাইলিন, টলোইন, ক্যালিটন, এমিকে, হাইপো, সোডিয়াম ক্লোরাইড, অ্যাডহেসিভ, সলিউশন, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, মিথানল, প্যারানলসহ নানা নামের রাসায়নিক আমদানি করা হয়। মাছ চাষ, মুরগির খামার, জুতা তৈরি, নখের পলিশ তৈরি, ট্যানারি, ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, প্লাস্টিক, সুগন্ধি, আগরবাতি তৈরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসব রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়।র্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মিটফোর্ডে অভিযান চালিয়ে গত বছর অসাধু আট ব্যক্তিকে জেল-জরিমানা করা হয়েছিল। আর রাসায়নিক দাহ্যের মধ্যে কিছু মনিটরিং করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও বিস্ফোরক অধিদফতর। কিন্তু অজ্ঞান পার্টির ব্যবহূত ক্লোরোফর্ম মনিটরিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। কিন্তু তা মনিটরিং করা উচিত।’ প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীর কোথাও না কোথাও অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। গত এক মাসে শতাধিক ব্যক্তি অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচজনই মারা গেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাস, লঞ্চ, ট্রেনস্টেশন ও রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন রাস্তার পাশে পড়ে থাকা অচেতন ব্যক্তিদের উদ্ধার করা হচ্ছে। এর বেশির ভাগই ঢামেক, মিটফোর্ড, সোহরাওয়ার্দীসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা যেসব ওষুধ ও রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করছে তা খুবই বিপজ্জনক।