শনিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
ঐতিহ্য

নওগাঁর পতিসর কাছারিবাড়ী

নওগাঁ প্রতিনিধি

নওগাঁর পতিসর কাছারিবাড়ী

নওগাঁর আত্রাই উপজেলার নাগর নদের তীরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পতিসর কুঠিবাড়ি অবস্থিত। পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত কালীগ্রাম পরগনার জমিদারি দেখাশোনার জন্য কবিগুরু ১৮৯১ সালে সর্বপ্রথম পতিসরে আসেন। জমিদারি দেখাশোনার জন্য এলেও প্রকৃতি ও মানবপ্রেমী কবি অবহেলিত পতিসর এলাকার মানুষের জন্য দাতব্য চিকিৎসালয় ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাসহ অনেক জনহৈতিষী কাজ করেন। এখানকার কৃষকের কল্যাণে নোবেল পুরস্কারের এক লাখ আট হাজার টাকা দিয়ে তিনি একটি কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। কবির সাহিত্য সৃষ্টির একটি বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে পতিসর। পতিসরে বসেই কবি চিত্রা, পূর্ণিমা, সন্ধ্যা, গোরা, ঘরে-বাইরেসহ অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেন। ১৯৩৭ সালের ২৭ জুলাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষবারের মতো পতিসরে আসেন। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বুকে নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে পতিসর কুঠিবাড়ি।

প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৯০ সালে কুঠিবাড়ির দায়িত্ব গ্রহণ করে। ১৮৩০ সালে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর কালীগ্রাম পরগনা জমিদারির অন্তর্ভুক্ত করেন। পতিসর কালীগ্রাম পরগনার সদর দফতর। নওগাঁ, বগুড়া ও নাটোর জেলার ৬০০টি গ্রাম নিয়ে কালীগ্রাম পরগনা গঠিত। এর আয়তন ছিল ২৩০ বর্গমাইল। রাতোয়াল আর ভান্ডারগ্রাম আরও দুটি সাব কাছারি ছিল। রাতোয়াল পতিসর থেকে ১০ কিলোমিটার আর ভান্ডারগ্রাম ২০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। কালীগ্রাম পরগনার সীমানা ছিল উত্তরে মালশন আদমদিঘী, দক্ষিণে আত্রাই নদী, পূর্বে নাগর নদ, পশ্চিম তীর আর পশ্চিমে নাগর বিধৌত বাঁকা-কাশিয়াবাড়ি গ্রাম। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের বাংলাদেশে ছিল তিনটি জমিদারি। পতিসরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাঁকে মুগ্ধ করে।

 মুগ্ধ করে কালীগ্রামের সহজ-সরল প্রজা সাধারণের ভক্তি ও শ্রদ্ধা। এখানে এসে তিনি কৃষকদের খুব কাছাকাছি আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। এতে কৃষকের অর্থনীতি সম্পর্ককে ভালো ধারণা জন্মেছিল। তিনি অনুন্নত পরগনার রাস্তা-ঘাট শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও দারিদ্র্য বিমোচনসহ নানাবিধ উন্নয়নমূলক কর্মসূচি হাতে নেন। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য পরগনাকে তিনটি বিভাগে ভাগ করেন। কালীগ্রাম ‘হিতৈষী সভা’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। কালীগ্রাম পরগনার প্রজাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে পতিসর, রাতোয়াল ও কামতা তিনটি বিভাগে তিনটি মধ্য ইংরেজি (এম ই) স্কুল ও পতিসরে ছেলে রথীন্দ্রনাথের নামে একটি হাইস্কুল স্থাপন করেন। স্কুলের ভবন, ছাত্রাবাস নির্মাণ ও অন্যান্য খরচ এস্টেট থেকে বহন করা হতো। পতিসরে অবস্থিত কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশনের প্রথমে নাম ছিল পতিসর এম ই স্কুল। পরবর্তীতে ১৯৩৭ সালে বিদ্যালয়টি হাইস্কুলে রূপান্তরিত হয়। ১৯১৩ সালে রাতোয়াল বিভাগে একটি বিদ্যালয় এবং কামতায় আরও একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথ জমিদারি পরিচালনার ক্ষেত্রে কখনো প্রজাপীড়ক ছিলেন না। তিনি খাজনা মওকুফ করেছিলেন তার সমগ্র জমিদারিতে। ১৯১০ সালে উত্তরবঙ্গে মহাপ্লাবনের পর আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় মহাশয়ের বন্যাত্রাণ ফান্ডে কিছু টাকা উদ্বৃত্ত হয়েছিল এবং এ টাকায় আমেরিকা থেকে কয়েকটি ট্রাক্টর ক্রয় করা হয়। ট্রাক্টর পাওয়া গেল, কিন্তু চালক পাওয়া গেল না। পুত্র রথীন্দ্রনাথ আমেরিকায় কৃষিবিদ্যা শিক্ষাকালে ট্রাক্টর চালনা করেছিলেন। পতিসরে তিনিই ট্রাক্ট্ররের ড্রাইভার রূপে আবির্ভূত হন। ট্রাক্টর দেখতে প্রথম দিন হাজার হাজার লোক এসেছিল। ১৯৩৭ সালে তিনি পতিসর ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় সব সম্পদ প্রজাদের মধ্যে দান করে দেন।

কাছারি বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই পড়বে রবিঠাকুরের আবক্ষ মূর্তি। এর ভাস্কর কণক কুমার পাঠান। ঘরগুলো কবির ব্যবহার্য বিভিন্ন তৈজসপত্র, নানা রকম সামগ্রী, তাঁর হস্তলিপি আর বিভিন্ন ছবিতে ভরা। একটি বাথটাব, একটি নোঙর, বিশাল আয়না, আরাম কেদারা, ওয়্যারড্রব, ঘড়ি, গ্লোব, সিন্দুক, খাজনা আদায়ের টেবিল, খাট, আলমারি ইত্যাদি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর