শনিবার, ৪ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

নীল চাষ করে স্বনির্ভর রংপুরের বহু পরিবার

রেজাউল করিম মানিক ও মর্তুজা নুর, রংপুর থেকে

নীল চাষ করে স্বনির্ভর রংপুরের বহু পরিবার

যে নীল চাষে বাধ্য করার প্রতিবাদে রংপুর অঞ্চলে ‘নীল বিদ্রোহ’ হয়েছিল কালক্রমে সেই প্রাকৃতিক নীল চাষ করেই স্বনির্ভর হয়েছে রংপুরের হাজারো পরিবার। নীল চাষের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে ডায়িং কারখানা। আর এই পণ্য যাচ্ছে বিদেশেও, আসছে বৈদেশিক মুদ্রা।

প্রায় সোয়া দুইশ বছর আগে রংপুর ও নীলফামারী অঞ্চলে চাষিদেরকে নীল চাষে বাধ্য করা হতো। সে সময় জমিদারদের সঙ্গে নীলচাষিদের বিবাদকে ঘিরে নীলবিদ্রোহ হয়েছিল। একপর্যায়ে ১৮৫৯-১৮৬০ সালের দিকে নীলচাষ বন্ধ হয়ে যায়। এত বছর পর সেই নীলচাষ আবার শুরু হয়েছে রংপুরে। কিন্তু তা চাষিদের কপাল পোড়াতে নয়, ভাগ্য ফেরাতে। স্থানীয় কৃষকরা বলেন, জৈব সার ও জ্বালানির প্রয়োজনে ১৩ বছর আগে বাড়ির পাশে উঁচুভিটা, পতিত জায়গায় আবার শুরু হয় নীলচাষ। ক্রমেই কৃষকদের অর্থনৈতিক ফসল হিসেবে এর চাষ বাড়ছে। আলু ও তামাক ওঠার পর আমন চাষের আগে যে জমি অব্যবহৃত থাকে তাতে নীল চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা। পানির অভাব বা রসের অভাবে জমি এখন আর পড়ে থাকছে না। নীল চাষ করায় জমির উর্বরতা বাড়ছে। নীলের উপরি অংশের পাতা ২-৩ বার কেটে নীল উৎপাদনের জন্য বিক্রি করায় তাদের আয় হচ্ছে বেশ। নিচের অংশ খড়ি বা লাকড়ি হিসেবে জ্বালানির কাজে লাগছে। পাতা পচানো অংশ কম্পোস্ট বা জৈব সার হিসেবে জমির উর্বরতা বাড়াচ্ছে। এতে তাদের বেশ লাভ হচ্ছে। তাই রংপুরের বিভিন্ন উপজেলায় বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের অনেক গ্রামে নীল চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কৃষকরা আরও জানান, ২০০৮ সালে রংপুর সদরের রাজেন্দ্রপুরে ‘নিজেরা কটেজ অ্যান্ড ভিলেজ ইন্ডাস্ট্রিজ (এনসিভিআই)’ নামে একটি সৃজনশীল প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এলাকার কয়েকজন। পাঁচ বছরে এনসিভিআইয়ের সদস্য ও পরিধি বেড়ে যায়। গড়ে ওঠে প্রাকৃতিক নীল ডায়িং কারখানা। তারা নীল গাছের পাতা সংগ্রহ ও তা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি করছেন নীল। সেই নীলে ডায়িং করা ব্যাগ, ফতুয়া, চাদর, নকশিকাঁথা ও বাহারি পণ্য তৈরি করে দেশ-বিদেশে বিক্রি করছেন তারা। উৎপাদিত নীল রপ্তানি হচ্ছে আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে। জানা গেছে, সৃজনশীল উদ্যোক্তারা প্রাকৃতিক রঙের পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে আসছেন বাজারে। আর শৌখিন গ্রাহক, পরিবেশপ্রেমীরা তার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। বাজারে প্রাকৃতিক রঙের চাহিদা বাড়ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা নীলের। এ চাহিদাকে পুঁজি করে আন্তর্জাতিক সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশ ‘লিভিং ব্লু’ নামের একটি কর্মসূচির মাধ্যমে নীল চাষের উদ্যোগ নিয়েছে। ওই কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় রংপুর জেলার রাজেন্দ্রপুর ও পাগলাপীর এলাকায় প্রায় দুই হাজার কৃষক তিন হাজার একর জমিতে নীল চাষ করছেন। এতে কৃষকরা যেমন লাভবান হচ্ছেন, তেমনি দেশ পাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। এ বিষয়ে লিভিং ব্লুর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিশায়েল আজিজ আহমেদ বলেন, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের অধিকার আদায়ে ২০০৫ সালে লিভিং ব্লু কাজ শুরু করে। প্রথমে সুশাসন নিশ্চিত করাই ছিল উদ্দেশ্য। এ কাজ করতে গিয়ে দেখা গেল দরিদ্র লোকেরা শুধু অধিকার চায় না, উপার্জনের উৎস চায়। তখন কীভাবে উপার্জনের ব্যবস্থা করা যায় তা নিয়ে ভেবেছে লিভিং ব্লু। দেখা গেল রংপুরের মানুষের নীল চাষের স্বাভাবিক দক্ষতা রয়েছে। নীলকে তারা ‘মাল গাছ’ হিসেবে চেনে। জমিতে যখন ফসল থাকে না অর্থাৎ দুই ফসলের মধ্যবর্তী সময়ে জমির উর্বরতা বাড়ানো ও জ্বালানির কথা চিন্তা করে এই মাল গাছ চাষ করেন অনেকে। লিভিং ব্লুর এক কর্মকর্তা এই মাল গাছ দেখে অবাক হলেন, তিনি দেখলেন এটা সেই নীল গাছ। তারপর পরীক্ষামূলকভাবে ব্যাপকভাবে চাষ করা হলো। এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। এ বছর এক টনের বেশি উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়েছে লিভিং ব্লু। এ বিষয়ে রংপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক ড. মো. সরওয়ারুল হক বলেন, রংপুরের বিভিন্ন এলাকায় সামান্য পরিমাণে নীল চাষ হচ্ছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান স্থানীয় চাষিদের কাছ থেকে নীল পাতা কিনে নিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে থাকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের গবেষকরাও নীল চাষ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন। কীভাবে এ চাষ আরও লাভজনক করা যায় তা নিয়ে নীতিনির্ধারকরা ভাবছেন। তিনি বলেন, নীল চাষ বেশ সহজ। এ জন্য উর্বর জমি লাগে না। আবার সার বা কীটনাশকের প্রয়োজনও হয় না। আগাছা দমনের কাজও তেমন নেই। ফলে চাষিরা সহজে এ চাষ করে লাভবান হতে পারেন।

সর্বশেষ খবর