বুধবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

সয়লাব নকল কসমেটিকে

পুরান ঢাকায় র‌্যাবের অভিযান, সাড়ে তিন কোটি টাকার নকল পণ্য জব্দ, অভিযান চলবে

নিজস্ব প্রতিবেদক

সয়লাব নকল কসমেটিকে

পুরান ঢাকায় গতকাল অভিযান চালিয়ে বিপুল নকল কসমেটিক্স জব্দ করা হয় -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ভেজালের দৌরাত্ম্য থেকে বাঁচতে দেশি কিংবা বিদেশি নামকরা ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর জন্য ভোক্তারা দেশের বিভিন্ন এলাকার নামিদামি দোকানের দ্বারস্থ হন। আবার কেউ কেউ আরও নিশ্চিত হতে নিজেদের সঁপে দেন দেশের বড় কোনো চেইন শপে। হুবহু লোগো কিংবা প্যাকেজিংয়ের জন্য অনেক সময় ভোক্তারা এমনকি অনেক সময় দোকানিও বুঝতে পারেন না কসমেটিকটি আসল নাকি ভেজাল। তবে সবচেয়ে উদ্বেগের খবর হলো, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো দেশের কয়েকটি নির্দিষ্ট এলাকা থেকেই কিছুদিন পরপর আবিষ্কার করছে ভেজাল প্রসাধনীর কারখানা। গ্রেফতার করে কারখানার মালিককেও। কিছুদিন পর কারাগার থেকে বের হয়ে এসে ওই একই ব্যক্তি পুনরায় চালু করছে ভেজাল কারখানা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এমন কর্মকা-ের পর ভেজালকে সঙ্গী করেই যেন সময় কাটছে অসহায় ভোক্তাদের। ভেজালই যেন হয়ে উঠছে জীবনের এক অবশ্যম্ভাবী অবিচ্ছেদ্য অংশ। অভিযোগ রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট দফতরের অসাধু কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতায় নকল ও ভেজাল পণ্যের বড় সিন্ডিকেট কাজ করে যাচ্ছে বছরের পর বছর। এতে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এসব পণ্য পরীক্ষা করে দেখা গেছে, নকল পণ্যে যেসব কেমিক্যাল ব্যবহার হয় তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হরহামেশাই তারা বিশ্বের বিখ্যাত ব্র্যান্ডের নকল পণ্যের ব্যবহারের শিকার রোগী পাচ্ছেন। এসব পণ্য ব্যবহারের কারণে অনেকেই বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। অস্বাভাবিক অবস্থায় চলে যাচ্ছে মানুষের ত্বক। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেও কোনো কাজে আসছে না। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর তথ্য হলো, প্রসাধনী ব্যবহার করে কিডনি জটিলতার শিকার হচ্ছেন অনেকে। গতকাল পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার এলাকায় তাজমহল টাওয়ারে অভিযান চালিয়ে তাকওয়া এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ৫০ ধরনের প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার নকল বিদেশি কসমেটিক্স জব্দ করেছে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় প্রতিষ্ঠানটির মালিক সাইফুদ্দীন চৌধুরী ও আবদুল আলীম নকীরসহ পাঁচজনকে দুই বছরের কারাদ- দেওয়া হয়। অভিযান শেষে বিএসটিআই ফিল্ড অফিসার মো. শরিফ হোসেন বলেন, তাকওয়া এন্টারপ্রাইজের একতলা থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত মোট চারটি গোডাউন। তাকওয়া এন্টারপ্রাইজ ফর্সাকারী বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ক্রিম, লোশন, শ্যাম্পু, সাবানসহ প্রায় ৫০ প্রকারের মতো প্রোডাক্ট তৈরি করে বাজারজাত করে আসছিল। যার সবগুলো নকল। এগুলোতে হাইড্রোক্লিন এবং মার্কারি নামক কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। ফলে তাতে মানবদেহে ক্ষতি হয় এবং ক্যান্সার পর্যন্ত হয়ে থাকে। ৯ মার্চ পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকায় প্রায় দুই কোটি টাকার নকল ও ভেজাল প্রসাধন সামগ্রী জব্দ করে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় জড়িত এক ব্যক্তিকে দুই বছরের কারাদ- ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। পাশাপাশি নকল-ভেজাল প্রসাধনীর ১০টি গুদাম সিলগালা করে দেয় র‌্যাব। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর চকবাজার এলাকায় নকল ও ভেজাল প্রসাধনীর গোডাউন ও দোকানে অভিযান চালিয়ে র‌্যাব-১০-এর সহায়তায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমের ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রায় ৫০ লাখ টাকার নকল প্রসাধনী জব্দসহ মালিক মনোয়ার হোসেন খোকন এবং ম্যানেজার মো. মিঠুকে দুই বছর কারাদ- ও পাঁচ লাখ টাকা করে জরিমানা করে।

ঢাকা ডার্মাটোলজি ইনস্টিটিউটের চিফ কনসালটেন্ট ডা. সরকার মাহবুব আহমেদ শামীম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভেজাল প্রসাধনী ব্যবহার করে দীর্ঘস্থায়ী চর্মরোগে ভুগছেন এমন অনেক রোগী আমি প্রায়ই পাচ্ছি। ল্যাবে পরীক্ষায় ওইসব নকল প্রসাধনীতে অতিমাত্রায় স্টেরওয়েড, মার্কারি ও হাইড্রোকুইনাইনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এতে ভুক্তভোগীদের স্থায়ীভাবে চামড়া পাতলা হয়ে যাচ্ছে। ত্বক অনিরাময়যোগ্য সংবেদনশীল হয়ে যাচ্ছে। অনেকের চামড়ায় দীর্ঘস্থায়ী লালচে ভাব চলে আসছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু, লোশন, ক্রিম, পাউডার, বডি স্প্রে ব্যবহারের পর ভোক্তারা সাধারণত খালি কৌটা ফেলে দিলেও নানা হাত ঘুরে এসব কৌটা আবার ভর্তি হয়ে চলে আসছে বাজারে। এ ছাড়া পুরান ঢাকার বিভিন্ন বাজারে নতুন ব্র্যান্ডের কৌটাও তৈরি হচ্ছে। অনেক সময় বৈধ-অবৈধ দুই পথেই চীন থেকে আসছে শুধু ব্র্যান্ডের নকল কৌটা আর বাহারি মোড়ক। তবে এসব কৌটায় ভেজাল প্রসাধনী ভরে বিক্রি হচ্ছে আসল দামে। বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে বিশ্ববিখ্যাত ও’লে, জনসন, ইউনিলিভার, গারনিয়ার, জিলেট ফোম, সানসিল্ক, অল ক্লিয়ার, পন্ডস ব্র্যান্ডের প্রসাধনী। মাঝেমাঝেই এসব পণ্য আসল পণ্যের সঙ্গে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন নামকরা সুপার শপগুলোতে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদেরও জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। হুবহু একই ধরনের মোড়কে তৈরি করা এসব নকল প্রসাধনী বাইরে থেকে দেখে সাধারণ কোনো ক্রেতার পক্ষে বোঝার উপায় নেই যে এটি নকল। ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপস্) মো. মনির হোসেন বলেন, আমরা এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। আমাদের দুটি ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে কাজ করে। খবর পাওয়া মাত্রই আমরা অভিযান চালাচ্ছি। তবে এক্ষেত্রে শুধু পুলিশ এগিয়ে এলেই হবে না, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যমেরও অনেক দায়িত্ব রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, দেশে যে পরিমাণ কসমেটিক্স অর্থাৎ স্নো, ক্রিম, শ্যাম্পু, সাবান, লোশন, আফটার-শেভ লোশন, পারফিউম এসব চাহিদা রয়েছে তার ১৫ শতাংশ পূরণ হচ্ছে দেশীয় কোম্পানির উৎপাদনে। আর ১৫ শতাংশ-আমদানি করা বিদেশি পণ্য। বাকি ৭০ শতাংশ কসমেটিক্স নকল ও ক্ষতিকারক উপাদান দিয়ে তৈরি হচ্ছে। পুরান ঢাকার চকবাজার, জিঞ্জিরা, ইসলামপুর এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা শহরে এই ভেজাল কসমেটিক্স তৈরির কারখানাগুলো গড়ে উঠেছে।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, বাজারে প্রতিষ্ঠিত অনেক ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর লেবেল ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ নেই। এক জরিপে দেখা গেছে, ৪৫ ভাগ প্রসাধন পণ্যের বিএসটিআইর সনদ নেই, ৭৫ ভাগ পণ্যের উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা নেই। একাধিক সূত্র বলছে, শুধু রাজধানী ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় তিন শতাধিক নকল প্রসাধন সামগ্রী তৈরির কারখানা রয়েছে। আর এগুলো কেরানীগঞ্জের জিনজিরা, চকবাজার, বেগমবাজার, রহমতগঞ্জ, কামালবাগ, খাজেদেওয়ান, ইসলামবাগ, দেবীদাসঘাট, বড় কাটারা, ছোট কাটারা ও কামরাঙ্গীরচরেই বেশি। এসব নকল কারখানার মালিকেরা কয়েক দফায় গ্রেফতার হয়েছিলেন। তবে জামিনে ছাড়া পেয়ে তারা পুনরায় একই পেশায় লিপ্ত হয়েছেন। পুরান ঢাকার চকবাজারে দেশি-বিদেশি নকল প্রসাধনী জগতের নেপথ্য গডফাদার হিসেবে খ্যাত খান মার্কেটের হাজী মফিজ। মফিজের পথ ধরে নকল প্রসাধনী ব্যবসায় আলোচিত হয়ে ওঠেন হাজী মাইনুদ্দিন। এ ছাড়াও রয়েছেন হাজী নবিউল্লাহ, হাজী শাহিন আহমেদ, আসাদুজ্জামান আসাদ, হাজী মোহাম্মদ আলী, ইকবাল হোসেন, মুক্তার হোসেন, ফারুক ও গোলাম হোসেন। চকবাজার এলাকায় খোরশেদ, নাসির, গোলাম, মকবুল, সিরাজ, লালু, মনোয়ার, মজিদ, আউয়াল, হাসান, নাজিম, নাজির, বিল্লাল, মোস্তাক, আজাদসহ অনেকেই।

একই এলাকায় কেন বারবার ভেজাল কারখানা? এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, আসলে এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। কর্তৃপক্ষই ভালো বলতে পারবেন। তবে এ বিষয়টি দেখভাল করার জন্য অনেকগুলো সংস্থার দায়িত্ব রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর