বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ধর্ষণ না করেও স্কুলছাত্র হলো ধর্ষণের আসামি

মাহবুব মমতাজী

ধর্ষণ না করেও স্কুলছাত্র হলো ধর্ষণের আসামি

রাজধানীর আদাবরে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস মিমের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। এ ব্যাপারে আদাবর থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়। ঘটনার চার মাস পর ময়নাতদন্তের রিপোর্টে ধর্ষণের বিষয়টি উঠে আসে। আদাবর থানা পুলিশ মেয়েটির বাবার কাছ থেকে ধর্ষণের মামলা নেয়। এজাহারে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। পুলিশ নতুন করে তদন্তে নামে। এ পর্যায়ে মেয়েটির সহপাঠী স্কুলছাত্র মামুনুর রশীদকে (১৭) গ্রেফতার করে পুলিশ।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর উত্তর আদাবরের ৫৫/২ নম্বর বাড়ির চতুর্থ তলা থেকে ১৪ বছর বয়সী এক স্কুলছাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। মেয়েটি শ্যামলী রিং রোডের বাদশাহ ফয়সল ইনস্টিটিউটের (স্কুল অ্যান্ড কলেজ) অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করেন আদাবর থানার তৎকালীন এসআই এরশাদ। তিনি সেখানে উল্লেখ করেন-প্রাথমিক আলামত বিশ্লেষণ করে মনে হয়েছে ঘটনাটি আত্মহত্যা। মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়ার জন্য লাশটির ময়নাতদন্ত করতে মর্গে পাঠানো হয়। ওই দিনই পুলিশ একটি অপমৃত্যুর মামলা নেয়। তরুণীর লাশটির ময়নাতদন্ত সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে সম্পন্ন হয়েছিল ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর। প্রথম মামলায় মেয়েটির বাবা মাওলাত হোসেন রানা উল্লেখ করেন, ঘটনার দিন জেএসসি পরীক্ষার ফল ঘোষণা হয়। তার মেয়ে আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় বিকাল সাড়ে ৩টায় বাসায় এসে ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় অনেক ডাকাডাকি করে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তার স্ত্রী লতা আক্তার দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে দেখেন তাদের মেয়ে জানালার গ্রিলের সঙ্গে ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস নিয়ে ঝুলে আছে। পুলিশ মামলাটি অপমৃত্যুর ঘটনা হিসেবেই তদন্ত করে। এ ঘটনার প্রায় চার মাস পর গত বছরের ১৯ এপ্রিল ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পায় পুলিশ। রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত পাওয়ায় ওই দিনই মেয়েটির বাবার কাছ থেকে গণধর্ষণের অভিযোগে অজ্ঞাত আসামি দেখিয়ে আরেকটি মামলা নেয়। এরপর গত বছরের ২৩ জুন ওই মেয়ের প্রেমিক মামুনুর রশীদকে (১৭) গ্রেফতার করে আদাবর থানা পুলিশ। মামুনও বাদশাহ ফয়সল ইনস্টিটিউটের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। তার ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা নিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠায়। কিন্তু মাসখানেক পর পরিস্থিতি ফের পাল্টে যায় ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়ার পর। গত ২৯ জুলাই পাওয়া ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্টে দেখা যায়, লাশে ধর্ষণের আলামতের সঙ্গে মামুনের ডিএনএর কোনো মিল নেই। মেয়েটির বাবা মামলার বাদী রানা এ প্রতিবেদককে বলেন, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর পুলিশ তার কাছ থেকে আরেকটি মামলা নেয়। বাসায় আমরা পুরনো একটি মোবাইল ঘেঁটে দেখি মামুনের সঙ্গে আমার মেয়ের অনেক মেসেজ আদান-প্রদান হয়েছে এবং তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক ছিল বলে মনে হয়েছে। থানা পুলিশ এসব জানার পর মামুন ও আমাদের বাসায় সাব-লেট থাকতেন সাজ্জাদ নামে আরেকজনকে গ্রেফতার করে। পরে তাদের ডিএনএ পরীক্ষায় দেখে যে ধর্ষণের সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১৩ জানুয়ারি তারা আরও ৮টি লাশের ডিএনএ রিপোর্ট তৈরি করেন। লাশগুলোর মধ্যে রাজধানীর আদাবর থানা ও শেরেবাংলা থানারও ঘটনা রয়েছে। তবে আদাবরে উদ্ধার হওয়া বাদশাহ ফয়সল ইনস্টিটিউটের ছাত্রীর লাশে পাওয়া শুক্রাণুর সঙ্গে মুন্নার ডিএনএর প্রোফাইলিংয়ে মিল পাওয়া গেছে। লাশ কাটা ঘরে মৃত নারীদের ধর্ষণের ঘটনায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গের ডোম মুন্না ভক্তকে গত ১৯ নভেম্বর গ্রেফতার করে সিআইডি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদাবর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সেলিম হোসেন বলেন, মামুনের ডিএনএ রিপোর্টে লাশের ধর্ষণের আলামতে মিল পাওয়া যায়নি- এটি আমরা আদালতকে জানিয়েছি। তবে ডোম মুন্নার সঙ্গে মিলেছে বলে সিআইডি থেকে জেনেছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা জটিলতার মধ্যে আছি। মামলা থেকে মামুনকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। তবে তিনি মামুনের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে এ প্রতিবেদককে কোনো কিছু জানাতে পারেননি। মামুনের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হয় বাদশাহ ফয়সল ইনস্টিটিউটে। প্রতিষ্ঠানটির সহকারী প্রধান শিক্ষক (বালক শাখা) মো. রফিকুল ইসলাম খাঁ এ প্রতিবেদককে জানান, গ্রেফতারের ঘটনার পরই তারা মামুনকে লাল টিসি দিয়ে বের করে দেন। এরপর শুনেছেন সে মামলা থেকে জামিন পেয়েছে। কিন্তু কোথায় আছে কিংবা কী করছে তার সম্পর্কে কিছু বলতে পারেননি। মামলা থেকে মামুনের অব্যাহতি পাওয়ার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মোতাহার হোসেন সাজু বলেন, ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্টের সূত্র ধরে মামুনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে ডোম মুন্নাকে আসামি করা উচিত হবে বলে তিনি মনে করেন। জানা গেছে, গত বছরের ১০ নভেম্বর ফরেনসিক ল্যাবে ‘কোডেক্স’ নামে সফটওয়্যারের ডাটা বিশ্লেষণ করে সিআইডির কর্মকর্তারা দেখেন- ৫টি লাশে এক ব্যক্তির ডিএনএ পাওয়া গেছে। পাঁচজনই কিশোরী। ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যার ঘটনায় এদের লাশ মর্গে নেওয়া হয়েছিল। এরপরই নড়েচড়ে বসেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। চলতি বছর আরও আট তরুণীকে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস) সামসুন নাহার জানান, প্রথম পাঁচটি ঘটনায় চার্জশিট প্রস্তুত হয়েছে। এরপর আরও কয়েকটি ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। সেগুলো নিয়েও তদন্ত চলছে।

সর্বশেষ খবর