রবিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

খুনে ভাই গুমে বাবা

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনে ভাই গুমে বাবা

নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার মহাসড়কের পাশে শিমুলতলা এলাকার একটি ঝোপের মধ্যে এক নারীর লাশ দেখতে পান পথচারীরা। লাশের খবরে গোটা এলাকার মানুষের মধ্যে নানা জল্পনা-কল্পনা। অপরিচিত নারীর লাশ ঘিরে সকাল থেকেই নানা গুঞ্জন। কেউ বলছে ধর্ষণের পর হত্যা করে দুর্বৃত্তরা ফেলে গেছে। আবার কেউ বলছে, অন্য কোথাও হত্যার পর গাড়ি থেকে নারীর লাশ ফেলে গেছে খুনিরা। আড়াইহাজার থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। লাশ উদ্ধার করে। লাশের গলা এবং শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। অজ্ঞাতনামা লাশের কোনো দাবিদার না পাওয়ায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। ২০২০ সালের ২৮ মের ঘটনা এটি। আড়াইহাজার থানা পুলিশ এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করে। আশপাশে প্রত্যেক থানায় এ বিষয়ে মেসেজ পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো থানাতেই কেউ নিখোঁজ হয়েছেন, এমন কোনো অভিযোগ কেউ করেননি। পুলিশের কাছে কোনো তথ্য আসে না অজ্ঞাত লাশের বিষয়ে। যে কারণে  শুরুতেই তদন্ত যায় থেমে। দিনের পর দিন যায়, সপ্তাহ মাস পেরিয়ে যায়। পুলিশের পক্ষে তরুণীর খুনিদের গ্রেফতার দূরের কথা পরিচয় পর্যন্ত উদঘাটন করতে পারেনি। দীর্ঘ আড়াই মাসের মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন আর সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করা ছাড়া তদন্তে আর কিছু যুক্ত করতে পারেনি। এরপর ওই বছরের ২৩ জুলাই খুনের তদন্তের ভার দেওয়া হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ওপর। পিবিআই লাশ উদ্ধারের পর ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে রাখে। পুলিশ তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে তরুণীর পরিচয় উদঘাটন করতে সমর্থ হয়। তাও সময় লেগে যায় ছয় মাস। তার নাম পাপিয়া। তিনি একজন গার্মেন্টকর্মী। তার বাবার নাম জয়নাল মিয়া। মা আছিয়া বেগম। তাদের বাড়ি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকায়। পুলিশ পাপিয়ার পরিচয় জানতে পারলেও সমস্যায় পড়ে যায় পুলিশ। পাপিয়ার পরিবার কেউ সঠিক কোনো তথ্য দিচ্ছিল না। একেক সময় একেক বক্তব্য দেওয়ায় পুলিশ পড়েন বিপাকে। পুলিশ পাপিয়ার বাবা জয়নালকে নজরদারিতে রাখে। পুলিশ এ সময় পাপিয়ার ফোন নম্বর নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকে। সেখানে একটি নম্বরের বিষয়ে পুলিশের সন্দেহ হয়। সেই নম্বরটি ছিল আরিফের। পুলিশ দেখতে পায় ঘটনার সময় আরিফের অবস্থান ছিল নারায়ণগঞ্জ। পুলিশ নভেম্বর মাসে তাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করে। এই আরিফের কাছ থেকেই বেরিয়ে আসে পাপিয়া খুনের নানা দিক।

গার্মেন্টকর্মী আরিফুল ইসলামের সঙ্গে অপর গার্মেন্টকর্মী পাপিয়ার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এই সম্পর্ক পাপিয়ার ভাই সাইফুল ইসলাম সাম্মি মেনে নিতে পারেনি। যে কিনা তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তরিত হয়ে শাম্মি নাম ধারণ করেছে। শাম্মিও চাইতো আরিফুল তার সঙ্গে প্রেমের মাধ্যমে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলুক। এই দ্বন্দ্বের জেরে ত্রিভুজ প্রেমের বলি হয় পাপিয়া। যার লাশ অজ্ঞাত হিসেবে উদ্ধার করে আড়াইহাজার থানা পুলিশ। পাপিয়ার সঙ্গে আরিফের প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে শাম্মির সঙ্গে ঝগড়া হতো। গত ২৭ মে প্রেমিক আরিফুল, পাপিয়া এবং তার ভাই সাইফুল পরে নামকরণ শাম্মি সবাই পাপিয়ার সিদ্ধিরগঞ্জের বাসায় ছিল। এ সময় পাপিয়া ও শাম্মির তুমুল ঝগড়া বাধে। ঝগড়ার কারণে আরিফুল বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে চাইলে বৃষ্টির কারণে যেতে পারে নাই। কিন্তু তার পরিচিত একই বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায় জনৈক সামিয়ার বাড়িতে অবস্থান করে। কিছুক্ষণ পরে আরিফুল পাপিয়ার ঘরে এসে পাপিয়ার লাশ ঘরের বিছানার ওপর দেখতে পায়। এ সময় পাপিয়ার গলায় ওড়না পেঁচানো ছিল এবং শাম্মি ঘর থেকে বের হয়ে পালানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু আরিফুল ঘরের ভিতরে চলে আসায় শাম্মি আরিফুলকে বলে যে, পাপিয়া বেঁচে আছে। পরে তারা একজন স্থানীয় ডাক্তারকে ডেকে এনে জানতে পারে পাপিয়া মারা গেছে। শাম্মির মাধ্যমে তার বাবা জয়নাল, পাপিয়ার মৃত্যুর খবর জানতে পেরে ঘটনাস্থলে আসেন। তারা একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে। তারা পরিকল্পনা করে পাপিয়ার লাশ গুম করবে। পাপিয়ার বাবা জয়নালের পরিকল্পনামতে আরিফুল ইসলাম, জয়নালের আরেক ছেলে মামুন এবং শাম্মি মিলে মৃত পাপিয়ার লাশ ভৈরব ব্রিজ থেকে নদীতে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনামতে তারা সবাই অ্যাম্বুলেন্সে পাপিয়ার লাশ তুলে নেয়। তারা রওনা হয় সিলেটের দিকে। কিন্তু পথিমধ্যে পুলিশের চেকপোস্ট থাকায় তারা আড়াইহাজারের শিমুলতলা নামকস্থানে রাস্তার পাশে জঙ্গলের ভিতরে পাপিয়ার লাশ ফেলে চলে যায়। পুলিশ পাপিয়ার বাবাকে গ্রেফতার করে। পিবিআই জানায়, আরিফুল ইসলাম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে বলেছেন, নিহত পাপিয়ার ভাই শাম্মি পাপিয়াকে হত্যা করেছে। এ ছাড়াও গ্রেফতারকৃত পাপিয়ার বাবা জয়নাল মিয়াকে দুই দিনের পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে জানায়, তার পরিকল্পনামতেই পাপিয়ার লাশ গুম করার জন্য আড়াইহাজার শিমুলতলা নামক স্থানে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে গেছে। ওদিকে সাম্মি এখনো গ্রেফতার হয়নি। তৃতীয় লিঙ্গ সাম্মির সঙ্গে কলকাতার তৃতীয় লিঙ্গ অনেকের পরিচয় রয়েছে। পুলিশের ধারণা কলকাতায় তাদের কাছে গেছে শাম্মি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর