আজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঐতিহাসিক বৈঠক। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে আজকের এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে। দেশের এই দুই শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্বের মধ্যে স্থানীয় সময় সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টার ‘ওয়ান টু ওয়ান’ রুদ্ধদ্বার বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে। এক সপ্তাহ ধরে দেশে-বিদেশে মানুষের মাঝে যে চাঞ্চল্য ও উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে তার অবসান হতে যাচ্ছে আজকের এই বহুলপ্রত্যাশিত বৈঠকের মধ্য দিয়ে।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব। আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল অ্যাওয়ার্ডসহ আরও অনেক পুরস্কার জয়ের মাধ্যমে দেশের সম্মান ও সুনাম বয়ে এনেছেন তিনি। অন্যদিকে তারেক রহমান বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের একজন শীর্ষ নেতা। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারান্তরিন এবং অসুস্থ হওয়ার পর তাঁর নেতৃত্বেই দলটি সুসংহত হয়েছে এবং সারা দেশে একটি শক্তিশালী জনভিত্তি তৈরি করেছে। তারেক রহমান বর্তমানে একজন বিচক্ষণ এবং সুবিবেচনাপ্রসূত নেতৃত্ব। তাঁর প্রজ্ঞা ও সুদৃঢ় নেতৃত্বের স্বাক্ষর এখন সর্বজনবিদিত। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের গণতন্ত্রকামী মানুষের প্রত্যাশা ‘দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেবে এই বৈঠক’।
সংশ্লিষ্ট একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, প্রয়োজনীয় সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে এবং ইতোমধ্যে দুই পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়েছে। আলোচনার মুখ্য বিষয় হচ্ছে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিএনপির পক্ষ থেকে আলোচনার প্রধান বিষয় হবে জাতীয় নির্বাচনের সময় এগিয়ে নিয়ে আসা। এজন্য উভয় পক্ষই ছাড় দিয়ে মাঝামাঝি একটা সময় বেছে নিলেই নির্বাচনের ভোট গ্রহণের সময়-সংক্রান্ত সমস্যার সুন্দর ও সম্মানজনক সমাধান হতে পারে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা। এ ক্ষেত্রে সরকার এপ্রিল (২০২৬) মাস থেকে সরে এলে, বিএনপিও ডিসেম্বর (২০২৫) থেকে সরে আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের সময় নির্ধারণের মাধ্যমে বিষয়টির সুরাহা করাটাই আলোচনা ও সমঝোতার প্রধান বিষয় হতে পারে।
এ ছাড়া চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার, গণহত্যাসহ অপরাধীদের বিচার, জুলাই চার্টারসহ (জুলাই সনদ) নানা ইস্যু আলোচনায় স্থান পাবে। এমনকি পরবর্তী নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন জাতীয় সংসদে অন্তর্বর্তী সরকারের সব কর্মকাণ্ড অনুমোদনের বিষয়সহ আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা হবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত। তাঁরা মনে করেন, দ্বিপক্ষীয় এই ঐতিহাসিক আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটা যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে চলমান রাজনীতিসহ অনেক কিছু জটিলাকার ধারণ করতে পারে। এমনকি বিপদগামী হতে পারে বাংলাদেশ। আবার কেউ কেউ বলেছেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এই বৈঠকের সার্বিক আলোচনা, মতবিরোধ ও সিদ্ধান্ত প্রকাশ করাটা কোনোক্রমেই ঠিক হবে না। বরং সেটি পর্যায়ক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে বাস্তবায়ন করা হতে পারে। কারণ আগেভাগেই এসব প্রকাশ করা হলে নানামুখী ষড়যন্ত্র বিস্তার লাভ করবে এবং দেশ ও জনস্বার্থে নেওয়া অনেক ভালো উদ্যোগও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে।
এ বিষয়ে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচন চায়, এটা নতুন কোনো বিষয় নয়। যেহেতু আমরা আলোচনায় যাচ্ছি, সে পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘শুধু বিএনপি নয়, সমগ্র জাতি আজ এই বৈঠকের দিকে তাকিয়ে আছে। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনের পথ সুগম হবে বলে প্রত্যাশা সবার। আমাদের বিশ্বাস, বৈঠক শেষে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান হাসিমুখে বেরিয়ে আসবেন। তাঁদের সেই প্রত্যাশিত হাসিই বলে দেবে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী বৈঠকের সমাপ্তি ঘটেছে। অতঃপর ফলাফল দেখে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে বিএনপি।’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘গোটা জাতির দৃষ্টি আজ লন্ডনের দিকে। আমাদের বিশ্বাস, এটি হবে একটি ঐতিহাসিক বৈঠক। এ বৈঠকের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে সুবাতাস বইবে। গণতন্ত্রের স্থায়ী পথ সুগম হবে।’
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ডিসেম্বরে নির্বাচনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছে বিএনপি। যৌক্তিক সময়েই নির্বাচন হবে বলে জাতি প্রত্যাশা করে। আলোচনার মধ্য দিয়ে নির্বাচনসহ সব সমস্যার সমাধানই সম্ভব।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের ভাষ্যমতে, ‘বৈঠকের ফল ইতিবাচকই হবে বলে বিশ্বাস করি। আশা করি আলোচনার মাধ্যমে একটা সমঝোতায় দুই পক্ষ পৌঁছাবে। এতে দেশের জন্য মঙ্গল হবে, রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে, নবদিগন্তের সূচনা হবে। এই আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে উভয় পক্ষকেই ছাড় দিয়ে হলেও অনেক বিষয়ে সমাধানে পৌঁছতে হবে। কারণ এই আলোচনা ব্যর্থ হলে বহুবিধ সংকট দেখা দেবে।’
সাবেক মন্ত্রী ও ১২-দলীয় জোটের প্রধান জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতি ও নির্বাচনের দিনক্ষণের ধোঁয়াশা কেটে যাবে। বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, ‘৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে পতিত স্বৈরশাসকের উসকানি এবং সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে, আশা করছি এই বৈঠকের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু সমাধান আসবে। দেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন ও গণতন্ত্রের পথ সুগম হবে।’ এদিকে মঙ্গলবার লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশন ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকে বাংলাদেশ নিয়ে যে কোনো বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। এই বৈঠকের নির্দিষ্ট কোনো এজেন্ডা (আলোচ্যসূচি) নেই। তারেক রহমান এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা এবং অধ্যাপক ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান। তাঁরা যখন বসবেন, তখন বাংলাদেশের এখনকার যে কোনো বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। আলোচনায় বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী জাতীয় নির্বাচন, জুলাই চার্টার (জুলাই সনদ) এগুলোর যে কোনো বিষয়ে আলাপ হতে পারে।
আজ লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলের সামনে অবস্থান নেবেন বিএনপির নেতাকর্মীরা : সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠককে স্বাগত জানিয়ে মঙ্গলবার রাতে প্রস্তুতি সভা করেছে যুক্তরাজ্য বিএনপি। আজ শুক্রবার সকালে হোটেলের সামনে যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতাকর্মীরা উপস্থিত হবেন। বৈঠক শেষ হওয়া পর্যন্ত বিএনপির নেতাকর্মীরা হোটেলের সামনেই অবস্থান করবেন।