গত ৮ মে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ উন্নত চিকিৎসার জন্য ব্যাংকক যান। বিদেশে যাওয়ার আগে তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানে মেডিকেল বোর্ড ক্যানসার আক্রান্ত সাবেক রাষ্ট্রপতির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে। উন্নত চিকিৎসার জন্য তারা আবদুল হামিদকে বিদেশে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। চিকিৎসকদের পরামর্শ নিয়ে সরকারের সব মহলকে অবহিত করে সাবেক রাষ্ট্রপতি ব্যাংকক যান। তিনি যথারীতি তাঁর প্রাপ্য ভিআইপি সুবিধা ব্যবহার করে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করেন। এ পর্যন্ত সবই ছিল ঠিক। পরদিন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা গাজীপুরের এক অনুষ্ঠানে বলেন যে তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতির ‘পালানোর’ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। যারা তাঁকে ‘পালাতে সাহায্য করেছে’ তাদের বিরুদ্ধে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে তিনি পদত্যাগ করবেন বলেও ঘোষণা করেন। তাঁর এই ঘোষণার পর হুলুস্থুল পড়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইমিগ্রেশনে দায়িত্ব পালনকারী তিনজন পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ নিয়ে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় তোলপাড়। আবদুল হামিদ পালিয়েছেন না সরকারের অনুমতি নিয়ে বিদেশে গেছেন, এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলে বিতর্ক।
উপদেষ্টাদের কেউই দায়িত্ব নিতে রাজি হন না। বরং তাঁরা রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিনের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সেই চেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। অবশেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ঘোষণা করেন যে তিনি ইন্টারপোলের মাধ্যমে আবদুল হামিদকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতিতে অনেক জল ঘোলা হতে থাকে। আবদুল হামিদের এই তথাকথিত পলায়নের ঘটনার জেরে আওয়ামীবিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়। নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের সেলিনা হায়াৎ আইভীকে কোনো মামলা ছাড়াই গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁর বিরুদ্ধে দেওয়া হয় হত্যা মামলা। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে জাতীয় নাগরিক পার্টি, জামায়াত এবং হেফাজতে ইসলাম আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগের রাজনীতি জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু নাটকের আসল ক্লাইমেস্ক এখনো বাকি। ৮ জুন আবদুল হামিদ চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসেন। একই বিমানে তিনি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিআইপি প্রোটোকল ব্যবহার করে নির্বিঘ্নে বাড়িতে চলে যান। মজার ব্যাপার হলো, যাওয়ার সময় তাঁর যে পোশাক ছিল শার্ট এবং লুঙ্গি; আসার সময় তিনি সেই শার্ট-লুঙ্গি পরেই এসেছেন। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় যে তিনি বেশ অসুস্থ।
যদি আবদুল হামিদ পালিয়ে গিয়ে থাকেন, তাহলে ফেরার সময় বিমানবন্দরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলো না কেন? তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা ছিল বলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ একাধিক উপদেষ্টা অভিযোগ করেছেন। সেই হত্যা মামলায় তো তাঁকে গ্রেপ্তার করার কথা। কিন্তু তাঁকে গ্রেপ্তারও করা হলো না। ঘটনার শেষ এখানেই নয়। এরপর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বললেন যে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ওয়ারেন্ট নাই। এজন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। যদিও তাঁর বিরুদ্ধে মামলা আছে। এই মামলার তদন্ত চলছে। তদন্তে তাঁর হত্যাসংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে। তাহলে এত জল ঘোলা করা হলো কেন?
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিজেই বলেছিলেন, ইন্টারপোলের মাধ্যমে আবদুল হামিদকে ফিরিয়ে আনবেন। নিজেই বলেছিলেন, আবদুল হামিদ পালিয়েছেন। আবার তিনি বললেন যে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নেই। অর্থাৎ তাঁর বিরুদ্ধে যদি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা না থাকে, তিনি যদি নির্বিঘ্নে দেশে ফিরতে পারেন তাহলে তিনি নির্বিঘ্নে বিদেশ যেতে পারবেন না কেন? এটি একটি ছোট্ট উদাহরণ।
উপদেষ্টারা কীভাবে সরকারকে বিতর্কিত, হাস্যকর করছেন, তাদের অযোগ্যতা, দায়িত্বহীনতা এবং লাগামহীন কথাবার্তার কারণে সরকার পদে পদে বিব্রত হচ্ছে। এটি যেন ঠিক পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আরেক রূপ। আওয়ামী লীগের কিছু মন্ত্রীর কথা নিশ্চয়ই জনগণের মনে আছে। ওবায়দুল কাদেরের অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ বাচনভঙ্গি এবং কথাবার্তা জাতিকে শুধু বিনোদনই দেয়নি, একপর্যায়ে জাতির ঘৃণা তৈরি হয়েছিল তাঁর এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। হাছান মাহমুদ বা মোহাম্মদ আলী আরাফাতের মতো আওয়ামী লীগের নেতাদের অরুচিকর লাগামহীন বেপরোয়া কথাবার্তা আওয়ামী লীগকে ডুবিয়েছে এটি অনেকেই মনে করেন। ঠিক একই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে পারছি এই সরকারের কারও কারও মধ্যে। অতিকথন, এখতিয়ারবহির্ভূত বিষয়ে কথা বলা এবং একই বিষয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে তাঁরা নিজেরা শুধু বিতর্কিত হচ্ছেন না, এই সরকারকে বিব্রত করছেন। সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছেন। আমরা স্থানীয় সরকারবিষয়ক উপদেষ্টার কথাই ধরি না কেন। তিনি তরুণ ছাত্রনেতা। জুলাই বিপ্লবে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। প্রথমে তিনি যুব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছিলেন। পরে তাঁকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দেওয়া হয়। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি একের পর এক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। এসব বিতর্ক থেকে বেরোনোর জন্য যেসব কথাবার্তা বলছেন, সেসব কথা তাঁকে আরও বিতর্কিত করছে। তাঁর সহকারী একান্ত সচিব ৬০০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। শুধু এটি নয়। বিতর্ক যেন তাঁর নিত্য সঙ্গী।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের ব্যাপারে নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল একটি রায় দেন। এই রায়টি প্রতিপালন না করে তিনি দীর্ঘ কালক্ষেপণ করেছেন। সিটি করপোরেশন ঘিরে একটি উত্তপ্ত আন্দোলন সূচনা করার সুযোগ দিয়েছেন। এই আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁকে ব্যাপক সমালোচিত হতে হয়েছে। তারপরও তিনি গোঁ ধরে আছেন। ঠিক যেন আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই। বিষয়টি আপিল বিভাগ পর্যন্ত গড়িয়েছে। আপিল বিভাগ এটি পাঠিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের কাছে। নির্বাচন কমিশন বলেছে তাদের কাজ শুধু গেজেট প্রকাশ করা। সেটি তারা করেছে। শপথের দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। তারপরও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এ নিয়ে কিছুই করেনি।
এবার পবিত্র ঈদুল আজহার সময় দেখা গেল, একটি অভিভাবকহীন নগরী কী রকম জঞ্জালে পরিণত হতে পারে। আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার নেতৃত্বে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বীরদর্পে ঘোষণা করল, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা সিটির সব আবর্জনা পরিষ্কার করা হবে। উত্তর সিটি করপোরেশনে তা-ও একটা সহনীয় অবস্থা ছিল। কিন্তু দক্ষিণে এখনো ময়লা-আবর্জনার স্তূপ পড়ে আছে। কারণ সিটি করপোরেশন অবরুদ্ধ। সেখানে কোনো কাজ হচ্ছে না। ফলে নগরের পরিচ্ছন্নতার কাজটিও এখন অচল হয়ে আছে। এই অবস্থার জন্য যে দায়ী স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা ছাড়া আর কেউ নন, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কেন তিনি গোঁ ধরে আছেন, কার স্বার্থ তিনি রক্ষা করছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন হতেই পারে। কিন্তু তাঁর কারণে পুরো ঢাকা শহরে একটা অরাজক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। আন্দোলন, বিশৃঙ্খলায় জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে ধারণা হয়েছে যে বিশেষ একটি উদ্দেশ্যের কারণেই হয়তো তিনি এ ধরনের সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন।
এবার ঈদে কোরবানির পশুর চামড়ার একটি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। এই নির্ধারিত মূল্যে যেন চামড়া বিক্রি হয়, সেজন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে বাণিজ্য উপদেষ্টার পক্ষ থেকে অভয়বাণী শোনানো হয়েছিল। কিন্তু এবার চামড়ার দাম এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। শুধু তা-ই নয়, চামড়ার বাজারে যেন হরিলুট হয়েছে। এরপর উপদেষ্টাদের স্ববিরোধী কথাবার্তা। শিল্প উপদেষ্টা বললেন, সিন্ডিকেটের কারণেই চামড়ার ন্যায্যমূল্য পাননি বিক্রেতারা। আবার বাণিজ্য উপদেষ্টা সদর্ভে বললেন, অন্য বছরের তুলনায় চামড়ার দাম এবার বেশি। এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তা বলার উদ্দেশ্য কী, সে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এরকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। একজন উপদেষ্টা তিন মাস আগে যা বলেছেন তিন মাস পর সেই অবস্থান থেকে কোথায় এলেন, তা যদি নিজে একবার আয়নায় দেখতেন তাহলে হয়তো নিজেরাই বিব্রত হতেন।
পরিবেশ উপদেষ্টার কথাই ধরা যাক না কেন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর পলিথিন নিয়ে তোলপাড় শুরু করলেন। সেই পলিথিন এখন বাজারে দেদার বিক্রি হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পলিথিনবিরোধী অভিযানও থেমে গেছে।
আমাদের যাঁরা সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাঁদের সব সময় দায়িত্বশীল আচরণ জনগণ প্রত্যাশা করে। তাঁরা যে কথাটা বলবেন, সেটি তাঁদের ব্যক্তিগত কথা নয়। তাঁদের কথা সরকারের বক্তব্য। কাজেই তাঁরা যখন কোনো বক্তব্য রাখবেন, সেই বক্তব্য অবশ্যই দায়িত্বশীল এবং পরিমার্জিত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু এই সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা এত দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য রাখছেন যে বক্তব্যগুলো শুধু সরকারকেই নয়, জুলাই বিপ্লবকেই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। আর একারণে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমরা আশা করব, প্রধান উপদেষ্টা এই বিষয়টি নজরে আনবেন। ব্যর্থ, অযোগ্য এবং যাঁরা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এবং উপদেষ্টা পরিষদ পরিবর্তন করে একটি নিরপেক্ষ অবয়ব তিনি ফিরিয়ে আনবেন। যাতে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন না ওঠে। কারণ এই উপদেষ্টামণ্ডলীর অনেককে নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে। তাঁদের নিরপেক্ষতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ।
অদিতি করিম, নাট্যকার ও কলাম লেখক
ইমেইল : [email protected]