বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা নিশ্চিতে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তোড়জোড় শুরু হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রিতে। এরই মধ্যে সংবিধান, সংসদ সচিবালয় এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয় গঠন সংক্রান্ত আইন ও এ সংক্রান্ত বিধিমালাসমূহ পর্যালোচনা করতে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাধীন বিচার বিভাগ পরিচালনা পদ্ধতিসমূহও সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে ওইসব কর্মকর্তাকে। সুপ্রিম কোর্টের নির্ভরযোগ্য সূত্র বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এসব তথ্য জানায়। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করতে ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলায় রায় দেওয়া হয়েছিল ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর। বিচার বিভাগকে শোষণ-বঞ্চনার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করতে এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থেকে দেওয়া ওই রায়ে ১২ দফা নির্দেশনা ছিল। রায়ের আলোকে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক ঘোষণা করে। এরপর ১২ দফার মধ্যে দু-এক দফার আংশিক ছাড়া অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে রায়ের আলোকে বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় গঠনসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু নির্দেশনার আংশিক এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। বিচারকদের নিয়োগ, কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, বরখাস্তকরণ, শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয়ে এখনো সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয় যৌথ এখতিয়ারের ভিত্তিতে কাজ করছে। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পালাবদলের পর বিচার বিভাগ ব্যবহার করে বিরোধী মত দমনের অভিযোগ ওঠে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে। ছাত্র-জনতার আলটিমেটামের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন তার সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি। এরপরই মূলত নতুন করে আলোচনায় আসে বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা প্রসঙ্গ। দাবি ওঠে ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার। গত ১৪ আগস্ট ‘ইয়াং জাজেস ফর জুডিশিয়াল রিফর্ম’ ব্যানারে তরুণ বিচারকরাও ১২ দফা প্রস্তাব দেন। এই ১২ দফার প্রথম দফাতেই ছিল- জেলা পর্যায়ের আদালতগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির জন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়’ গঠন এবং মাসদার হোসেন মামলার সব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে।
এরপর গত শনিবার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের দেওয়া অভিভাষণে বিচার বিভাগে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। সেদিন প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচারকদের প্রকৃত স্বাধীনতা ততদিন পর্যন্ত নিশ্চিত হবে না, যতদিন পর্যন্ত বিচার বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা বিলোপ করে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা না হবে। পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা হবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রথম ধাপ। জরুরি ভিত্তিতে এ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পাঠানো হবে বলেও জানান প্রধান বিচারপতি। ওইদিন মঞ্চে উপস্থিত আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলও প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের সমর্থন করেন। প্রস্তাবনা তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র মো. মোয়াজ্জেম হোছাইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রধান বিচারপতির অভিভাষণে দেওয়া বক্তব্যের আলোকে আমরা পৃথক সচিবালয় গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাবনা তৈরির কাজ শুরু করেছি। সংশ্লিষ্টরা বলেন, মাসদার হোসেন মামলায় আপিল বিভাগের রায় দেওয়ার পর প্রায় দুই যুগের বেশি সময় পার হয়েছে। কিন্তু বিচার বিভাগ এখনো দ্বৈত শাসনেই চলছে। অর্থাৎ নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে মিশে আছে বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগের প্রতিটি কাজ নির্বাহী বিভাগের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যে কোনো ফাইল সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো হয়, এরপর সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে আইন মন্ত্রণালয় সেটার বাস্তবায়ন করে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা বলেন, এই দ্বৈত শাসনের কারণেই এতদিনেও বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়নি। তারা বলেন, কোনো রাজনৈতিক সরকার বিচার বিভাগের ক্ষমতা হাতছাড়া করতেও চাইবে না। তাই এই অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েই দ্রুত সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকার পতনের পর পরই আমি জুডিশিয়াল রিফর্মের বিষয়ে তিনটি দাবি তুলে ধরেছিলাম। দাবি তিনটি হচ্ছে, উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে আইন করে বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া, আইন কর্মকর্তা নিয়োগে আইন বা নীতিমালা প্রণয়ন করে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া এবং বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা নিশ্চিতে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা। তিনি বলেন, সচিবালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে অলরেডি সুপ্রিম কোর্টের রায় রয়েছে। রায়ে সবকিছু স্পষ্ট করে বলার পরও রাজনৈতিক সরকার এই সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করেনি। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় থাকলে আইন মন্ত্রণালয় আইনমন্ত্রীর অধীনে থাকে। ফলে সব নিয়োগ, বদলি পদোন্নতির বিষয়ে কলকাঠি নাড়েন আইনমন্ত্রী। বিগত সরকারের সময়ে আমরা তাই দেখেছি। রাজনৈতিক সরকার কখনোই চাইবে না এসব ক্ষমতা হাতছাড়া করতে। মনজিল মোরসেদ বলেন, আসলেই যদি বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা আমরা চাই, তাহলে প্রধান বিচারপতির অধীনে বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং এই সচিবালয় প্রতিষ্ঠার সময় এখনই। জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এক এগারো সরকারের সময়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রথম ধাপ পেয়েছিলাম। সেই সময়ে নির্র্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করা হয়। তবে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা আসেনি। তিনি বলেন, পরবর্তীতে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এসে মুখে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বললেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েই সুপ্রিম কোর্টের অধীনে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার উত্তম সময়।