শেষ মুহূর্তের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে স্থগিত হয় ৪০তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের পাসিং প্যারেড। প্রশিক্ষণ শেষ হলেও সমাপনী কুচকাওয়াজ ‘হঠাৎ’ স্থগিত করায় চাকরিতে যোগদান অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে ৬২ জন শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণার্থীর।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশিক্ষণ চলাকালীন ক্যাডারদের নানা অনিয়ম এবং তাদের উত্তীর্ণ করানোর বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিমাত্রায় তৎপরতার বিষয়টি উঠে আসে একাধিক সংস্থার প্রতিবেদনে। একই সঙ্গে সারদা পুলিশ একাডেমিতে যাওয়ার আগে প্রশিক্ষণার্থীদের ভূমিকা নিয়েও বিস্তারিত উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। তবে অনেক কর্মকর্তা বলছেন, কুচকাওয়াজ স্থগিত করতে হলে পুলিশ সদর দপ্তরের উচিত ছিল তা আগেই জানিয়ে দেওয়া।
রাজশাহীর সারদায় পুলিশ একাডেমিতে শিক্ষানবিশ এএসপিদের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ হওয়ার কথা ছিল গত রবিবার। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, পুলিশ মহাপরিদর্শক ময়নুল হোসেনসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতনরা উপস্থিত হয়েছিলেন সেখানে। তবে রাত ৯টার দিকে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। দীর্ঘ সময় ধরে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন ঊর্ধ্বতনরা। সিদ্ধান্ত হয় পরদিন পাসিং আউটে অংশ নিতে যাওয়া শিক্ষানবিশ এএসপিদের প্যারেড স্থগিতের। মধ্য রাতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের তরফ থেকে প্যারেড স্থগিতের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয় গণমাধ্যমকর্মীদের। পরদিন, রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) সদর দপ্তরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। কুচকাওয়াজ স্থগিতের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অনিবার্য কারণে স্থগিত করা হয়েছে।’ এরপর সাংবাদিকেরা একাধিকবার প্রশ্ন করলেও ‘ওটা ক্লিয়ার করা হয়েছে, ভালো থাকেন’ বলেই তিনি চলে যান। এ সময় তাঁর সঙ্গে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ময়নুল ইসলামসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। অনুসন্ধান এবং একাধিক সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একাধিক সংস্থার রিপোর্টে উঠে এসেছে, ৪০তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে প্রথম হওয়া কাজী ফাইজুল করীম খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) এর সাবেক আহ্বায়ক। সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণে যাওয়ার আগে তার এবং আরেক শিক্ষানবিশ কন্টিনজেন্ট কমান্ডার আরমান, সোহেল রহমানের নেতৃত্বে ৪০তম বিসিএস পুলিশে নির্বাচিত হওয়া অন্তত ২৫ জন সদস্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক তথ্যমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নূরুল ইসলামের সঙ্গে ফুল দিয়ে সাক্ষাৎ করেন। সারদায় প্রশিক্ষণে যাওয়ার আগে শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হতে যাওয়া এসব ক্যাডারদের এমন আচরণ নিয়ে তৎকালীন সরকারের কর্তাব্যক্তিরা কোনো প্রশ্ন তোলার বিপরীতে প্রশংসা করেছিলেন। কারণ ওই ২৫ জন শিক্ষানবিশ ক্যাডার বিভিন্ন ইউনিটের ছাত্রলীগের পদধারী। তাদের নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আশপাশের এলাকা এবং নিজ এলাকায় তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ।
এদিকে, গত ৫ জুন সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ তাঁর ফেসবুক পেজে বিভিন্ন পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত সদস্যদের পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। দিয়েছিলেন একটি দীর্ঘ স্ট্যাটাস। এক যুগ পূর্তিতে ৩০তম বিসিএস-এর কর্মকর্তারা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ছবিও পোস্ট করেছিলেন তিনি। বহুল আলোচিত সেই স্ট্যাটাসের একটি অংশে তিনি লিখেছিলেন, ‘পেশাদারিত্ব বাদ দিয়ে এসব দেখা সাক্ষাতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে, সুযোগ দিলে তো ঘরে আর মন টিকবে না। এ রাস্তা একবার চিনে ফেললে তাদের কাছে শিক্ষা, নেতৃত্ব, দক্ষতা, যোগ্যতা কোনো মূল্য বহন করবে না। মেধার বদলে সর্বনাশা চাটুকারিতার বিজয় দেখতে হবে সর্বত্র। প্রয়োজন আর অপ্রয়োজন, কাজ আর অকাজের সীমারেখা টানতে জানতে হবে-সবাইকেই। প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করলে দায়ভার সবাইকেই নিতে হবে। আমরা বড্ড পুরনো, সেকেলে। পরিবর্তনটা বুঝতে পারছি না হয়তো। এত বছর চাকরি করলাম, এসব অকাজ দেখলে কষ্ট লাগে। হতে পারে নতুনদের সারভাইভেল টিপস। নতুন সংস্কৃতি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেছেন, সারদায় প্রশিক্ষণরত ৪০তম বিসিএস এর অন্তত ৪০ জন প্রশিক্ষণার্থীর বিষয়ে নিয়মিত খোঁজখবর নেওয়া হতো পুলিশ সদর দপ্তর থেকে। ট্রেনিংয়ে খারাপ করার পরও তাদের পাস করাতে বাধ্য ছিলেন সেখানকার কর্তৃপক্ষ। ওপর মহলের দৃষ্টির বিষয়ে অবগত থাকায় এসব প্রশিক্ষণার্থীরা তাদের সব সময়ই নিয়মের ঊর্ধ্বে ভাবতেন। তাদের অপেশাদারিত্বমূলক আচরণে রীতিমতো বিব্রত হলেও করার কিছু ছিল না কর্তৃপক্ষের। এমন অবস্থা শুধু পুলিশে নয়, অন্য সব ক্যাডারেও ঘটেছে বলে মন্তব্য করেন তারা।
তারা আরও বলেন, পুলিশে অতি মাত্রায় রাজনীতি প্রবেশ করার কারণে শৃঙ্খলাজনিত অপরাধকে আমলেই নেওয়া হতো না সুশৃঙ্খল এই বাহিনীতে। প্রশিক্ষণার্থীদের বাইরে একাডেমিতে কর্মরতরাও নানা অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছিলেন দীর্ঘদিন ধরে।
জানা গেছে, সারদা পুলিশ একাডেমিতে কর্মরত ৩৩তম বিসিএস-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তারিক রহমান সারদায় প্রশিক্ষণরত একজন নারী ক্যাডেট এসআইয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। হরহামেশাই তারা একান্তে মিলিত হতেন। বিষয়টি সারদায় ওপেন সিক্রেট ছিল। পুলিশ সদর দপ্তর অবহিত হওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করছিল দীর্ঘদিন। এর মধ্যেই তিনি দুই কনস্টেবলকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। তবে সরকার পরিবর্তনের পর ওই কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে কর্তৃপক্ষ।
একইরকমভাবে সারদায় কর্মরত ওস্তাদ এএসআই জিল্লুর রহমান নামের একজন প্রশিক্ষণার্থী নারী ক্যাডেটের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এ বিষয়টিও ওপেন সিক্রেট ছিল সারদা পুলিশ একাডেমিতে। তবে এ বিষয়ে রহস্যজনকভাবে নীরব থাকে পুলিশ প্রশাসন। অবশেষে গত ২০ দিন আগে জিল্লুরকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে কর্তৃপক্ষ।
সূত্র বলছে, এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমন্বয়ক ওই ৬২ জনকে ‘ছাত্রলীগের ক্যাডার’ উল্লেখ করে ওই অনুষ্ঠানে যোগদানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে জানালে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চাওয়া হয় গোয়েন্দা প্রতিবেদন। প্রতিবেদন পাওয়ার পর মূলত এ কারণেই শনিবার রাতে অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই আজকের কুচকাওয়াজটি স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
জানা গেছে, ৬২ জন প্রশিক্ষণার্থীর মধ্যে তিনজন ৩৮তম বিসিএস-এর বাকিরা সবাই ৪০তম বিসিএস-এর মাধ্যমে নির্বাচিত। শুরুর দিকে এই দুই ব্যাচের নির্বাচিতদের সংখ্যা ছিল ৭১ জন। তাদের মধ্যে চারজন প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়েই একাডেমি ত্যাগ করেন। একজন অসুস্থতার জন্য শেষের দিকে আর প্রশিক্ষণে অংশ নেননি। চারজন অকৃতকার্য হয়েছেন।