পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ভূসম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার ৪১৯ একর। এর বর্তমান বাজারমূল্য ২ লাখ কোটি টাকার বেশি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন প্রকল্পের আরও ৩ হাজার একর জমি। এর মধ্যে বেহাত হয়ে গেছে ৭ হাজার বিঘা। এ ছাড়া রেলের পরিত্যক্ত ও অব্যবহৃত প্রায় ১২ হাজার ৯ একর জমি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ইজারা দেওয়া আছে। পশ্চিমাঞ্চল রেলসূত্রে জানা গেছে, পশ্চিমাঞ্চলজুড়ে রেলের জমি সবচেয়ে বেশি দখল হয়েছে আটটি জেলায়। এর মধ্যে সৈয়দপুরে আড়াই হাজার বিঘা, সিরাজগঞ্জে ২ হাজার বিঘা, রাজশাহীতে দেড় হাজার বিঘা, রাজবাড়ীতে ২ হাজার বিঘা, লালমনিরহাটে আড়াই হাজার বিঘা, চুয়াডাঙ্গা, ঈশ্বরদী ও পাকশীতে হাজার একর করে জমি বেদখল হয়ে আছে।
এ ছাড়া সান্তাহার জংশন, বগুড়া, খুলনা, কুষ্টিয়া, গোয়ালন্দঘাট, ফরিদপুরের ভাঙ্গা, যশোর ও গাইবান্ধার বোনারপাড়া ও ফুলছড়ি ঘাট দিনাজপুরের পার্বতীপুর এলাকায় বিপুল পরিমাণ রেলভূমি বেহাত হয়ে আছে। রেলের ভূসম্পত্তি বিভাগের তথ্যমতে, ১৯২৩ সালে নির্মিত ২৫ দশমিক ৮৪ কিলোমিটার দীর্ঘ রাজশাহীর গোদাগাড়ী সেকশনের রেললাইনটি ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরপরই বন্ধ করা হয়। এ সেকশনে রেলের মোট জমির পরিমাণ ৭২০ একর। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা।
বিপুল পরিমাণ এ জমির এক ছটাকও রেলের হাতে নেই। পুরোটাই বেদখলে আছে। আইন না থাকলেও এসব জমি একের পর এক হাতবদল হচ্ছে। অপরদিকে রেলওয়ের কাছে অনুমোদন না নিয়েই আমনুরা-গোদাগাড়ীর রেলবাজার পর্যন্ত পরিত্যক্ত রেললাইনটির ওপর দিয়ে পাকা সড়ক করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ। জানা যায়, আমনুরা-গোদাগাড়ী সেকশনের দিগরাম-ঘুণ্টিঘর এলাকায় রেলের একটি বড় পুকুর অবৈধভাবে দখল ও ভরাট করে প্লট আকারে বিক্রি করছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ইসরাইল মোড়ল ও তাঁর সহযোগীরা। এর আগে দীর্ঘদিন রেলের সাড়ে তিন একর আয়তনের পুকুরটি দখলে নিয়ে ভোগ করছিলেন ইসরাইল। সম্প্রতি পুকুরটি ভরাট করেছেন তিনি। এখন ৩ লাখ টাকা কাঠা করে প্লট বিক্রি করছেন। রেলের জমি প্লট করে বিক্রি করলেও পশ্চিম রেলের ভূসম্পত্তি বিভাগ নীরব।
এভাবেই পশ্চিমাঞ্চলজুড়ে রেলের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি বেদখল হয়ে গেছে। এসব জমি উদ্ধারে রেল কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আবার সৈয়দপুর পৌরসভার যোগসাজশে রেলের বিপুল পরিমাণ জমি দখল করে রাখা হয়েছে। রেলসূত্রের দাবি, ১৯৭৯ সালে রেলের ২৫ একর ৫০ শতক জমির লাইসেন্স ফি তোলার দায়িত্ব নেয় সৈয়দপুর পৌরসভা। চুক্তি অনুযায়ী লাইসেন্স ফির অংশ পৌরসভা ও রেলের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন হওয়ার কথা ছিল। প্রথম বছর রেলকে কিছু রাজস্ব দিলেও পৌরসভা পরে আর এক টাকাও দেয়নি। নথিতে ২৫ একর হলেও সৈয়দপুরে শতাধিক একর জমি পৌরসভার ছত্রছায়ায় দখলদারদের হাতে চলে গেছে। এ বিষয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলের ভূসম্পত্তি শাখার কর্মকর্তারা জানান, লোকবল সংকট ও অর্থ না থাকায় তাঁরা বেদখল হওয়া জমি উদ্ধারে অভিযানে নামতে পারছেন না। তবে সরকার এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিগগিরই অভিযানে নামবে তারা। জানা গেছে, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পরিত্যক্ত ও অব্যবহৃত প্রায় ১২ হাজার ৯ একর জমি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ইজারা দেওয়া আছে। এসব ইজারা বাবদ পশ্চিম রেল গত অর্থবছরে ২৭ কোটি ৩ লাখ ২৩ হাজার ৫৬৭ টাকা রাজস্ব পেয়েছে। পশ্চিম রেলের সবচেয়ে বেশি জমি আছে সৈয়দপুর, পার্বতীপুর, লালমনিরহাট, সান্তাহার, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, ঈশ্বরদী, পাকশী, রাজবাড়ী ও চুয়াডাঙ্গা জেলায়। এসব এলাকায় দখলের পরিমাণও অনেক বেশি। পশ্চিম রেলের প্রধান ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মাহ্মুদা পারভীন বলেন, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ অভিযানে গেলেই দখলদাররা আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে হাজির হন। এস্টেট শাখায় মামলা পরিদর্শকের অভাবে এসব মামলার সার্বক্ষণিক তদারকি করা যায় না। এ ছাড়া দখলদারদের বিরুদ্ধে থানা-পুলিশ মামলা নেয় না। আদালতে গেলেও মামলা পরিদর্শকের সঙ্গে সমন্বয়ের অভাবে মামলা করা যায় না। রেলসূত্রে জানা যায়, উত্তরে পঞ্চগড় থেকে দক্ষিণে বাগেরহাট এবং পূর্বে গাজীপুর থেকে পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়াও রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও ঢাকা বিভাগের টাঙ্গাইল, বৃহত্তর ফরিদপুর, আংশিক গাজীপুর এবং ময়মনসিংহ বিভাগের অর্ধেকাংশ সেকশন লাইন পশ্চিমাঞ্চলীয় রেলের অধিভুক্ত। এই বিরাট এলাকার ভূসম্পত্তির দায়িত্বে আছেন একজন প্রধান ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা, তিনজন বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা, তিনজন সহকারী ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা, চারজন সার্কেল কর্মকর্তা, নয়জন কানুনগো, আঠারোজন আমিন, তিনজন মামলা পরিদর্শক, চারজন ট্রেসারসহ কয়েকজন কর্মচারী। বিপুল পরিমাণ এই সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য জনবল প্রয়োজন বর্তমানের চেয়ে চার গুণ।