২০০৬ সালের ২ আগস্ট। ময়মনসিংহের ভালুকার জামিয়া ইসলামিয়া নুরুল উলুম কওমি মাদ্রাসার ঘটনা। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব-৯) একটি দল ওই মাদ্রাসায় অভিযান চালিয়ে একটি চাপাতি, একটি ছুরি, ২০০ পিস সাদা মরিচা বাল্ব, এক কেজি ওজনের (হলুদ পাউডার ভরা সাদা রঙের মুখ বন্ধ) একটি কৌটা, আড়াই কেজি জালের কাঠি উদ্ধার করে। ওই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে আটক করা হয় ২৫ জনকে। তাদের আসামি করে ভালুকা থানায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনে মামলাও করে পুলিশ। পরের বছরের ১৮ জানুয়ারি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী আকবর তদন্ত করে ২৮ জনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনে পৃথক দুটি অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
২০০৯ সালের ১৬ জুন আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। পাঁচ বছর পর গত ৯ এপ্রিল অস্ত্র আইনের মামলায় রায়ে আদালত ২৮ আসামির সবাইকে বেকসুর খালাস দেন। তবে বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলায় দুজন বাদে ২৬ জনকে খালাস দিয়েছেন আদালত। ট্রাইব্যুনালের বিশেষ কৌঁসুলি আবু আবদুল্লাহ ভূইয়ার মতে, আসামিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলার জন্য যেসব আলামত দেখানো হয়েছে, তা অস্ত্র আইনে পড়ে না। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া বিস্ফোরকদ্রব্যও রাসায়নিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়নি।
শুধু ভালুকার এ ঘটনাটিই নয়, সারা দেশে এমন অসংখ্য মামলার দশা একই। এমনকি স্পর্শকাতর জঙ্গি মামলা, হত্যা, চাঁদাবাজি, ডাকাতিসহ অন্যান্য গুরুতর অপরাধের অধিকাংশ মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে পুলিশ আদালতে অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হচ্ছে। এর ফলে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা। অনেক ক্ষেত্রে তারা আরও বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এ জন্য রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, প্রভাবশালীদের চাপ, পুলিশের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা এবং মামলা তদন্তে পুলিশের সদিচ্ছার অভাবকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের নিম্ন আদালতে ২০১৩ সালে নিষ্পত্তি হওয়া ৭০ শতাংশের বেশি ফৌজদারি মামলা সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে টেকেনি। তাই অনেক ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর অপরাধ করেও আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে, কিছু মামলায় সাজা হলেও সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে লঘু শাস্তি হচ্ছে। পরে তারা উচ্চ আদালতে গিয়ে অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছেন। এদের আবার অনেকেই খালাস পেয়ে আরও বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য মিলেছে। আদালত সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে দেশে ২৪ দশমিক ১ শতাংশ মামলায় আসামির সাজা হয়েছে। তবে সিআইডি তদন্ত করছে এমন মামলায় সাজার হার ৩৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। পুলিশ সদর দফতর মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ অপরাধবিষয়ক বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বিভিন্ন মামলার তদন্তের এ উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরা হয়। ওই প্রতিবেদনে ২০১২ সালের হিসাবে দেখানো হয়, সারা দেশে বিভিন্ন মামলায় মাত্র ২৩ শতাংশ অপরাধীর সাজা হয়েছে। ৭৭ শতাংশের বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। থানায় দায়ের হওয়া মামলার মধ্যে তদন্ত করে ৬৬ শতাংশের অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। আদালতে ফৌজদারি মামলার অভিযোগ প্রমাণ না করতে পারার ব্যাপারে সরকারি কেঁৗসুলিরা বলেছেন, পুলিশ ইচ্ছা করে মামলা দুর্বল করে দেয়। আবার পুলিশ বলেছে, রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের সদিচ্ছার অভাব এবং সাক্ষী না পাওয়া অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ার বড় কারণ।
পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা জানান, মামলা দায়ের ও তদন্ত প্রক্রিয়ায় নানা ধরনের সমস্যা আছে। যেমন মামলার বিবরণ তৈরি করা হয় মৌখিক সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে। তদন্তও হয় সেভাবেই। খুব কম ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়। এ ক্ষেত্রে বিচারের দীর্ঘসূত্রতাও একটা বড় ব্যাপার। কারণ বিচার দীর্ঘায়িত হলে সাক্ষীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, আসামি খালাস পেয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ সাক্ষী না পাওয়া। দেখা গেছে, ঘটনা সঠিক, কিন্তু সাক্ষী নেই বা কাউকে সাক্ষী করা যাচ্ছে না। ফলে আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। মামলা করার সময় সাক্ষী যা বলেন, বিচারের সময় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তিনি উল্টো কথা বলেন। আবার যারা সাক্ষী হন, তাদের বেশির ভাগই নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর। তাই প্রভাবশালী আসামিরা অনেক সময় টাকার বিনিময়ে তাদের কিনে নেন। ভয়ভীতি দেখান। আবার কোনো কোনো সময় সাক্ষী আসতেই চান না। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশের তদন্তেও দুর্বলতা থাকে বলে তিনি স্বীকার করেন। শুধু আসামির স্বীকারোক্তি ও সাক্ষীর মুখের বক্তব্যকে ভিত্তি করার কারণে মামলা দুর্বল হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা গেলে এ সমস্যা থাকত না। সাক্ষীর অভাবে আসামিরাও পার পেতেন না।