প্রকাশ্যে সংঘটিত হচ্ছে গণধর্ষণ এবং এই গণধর্ষণের খেলা আবার প্রথা হিসেবেও পরিচিত! যদিও, কোন কোন ক্ষেত্রে এই খেলায় আক্ষরিক অর্থে গণধর্ষণে মেতে ওঠে উন্মত্ত অংশগ্রহণকারীরা। তবে আক্ষরিক হলেও, সেই পৈশাচিক আচরণের জেরেও নারীদের কম অসম্মান, হেনস্তা এবং যন্ত্রণার সম্মুখীন হতে হয় না। আক্ষরিক অর্থে হলেও, ধর্ষকদের যেমন সুরক্ষা দেওয়া হয়, তেমনই এই গণধর্ষণের খেলা উপভোগের জন্যেও উপস্থিত থাকে বিশাল সংখ্যক দর্শক।
শুধুমাত্র তাই নয়। বিশাল সংখ্যক মানুষকে আবার পৈশাচিক এই আচরণের বিষয়ে বিভ্রান্ত করাও হয়। ক্রমে যেখানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সৌজন্যে দুনিয়া আরও বদলে যাচ্ছে সেখানে, নারীদের উপর এমন পৈশাচিক আচরণ খেলা হিসেবে অনুমতি পেতে পারে!! প্রকাশ্যে এ ভাবে গণধর্ষণ প্রথা হিসেবে পালিত হতে পারে!!
তবে এমন বিভিন্ন বিস্ময়ের তুলনায় অধিক বিস্ময়ের বিষয় হল, সংঘটিত এই গণধর্ষণের বিরুদ্ধে সেভাবে প্রতিরোধও নেই! নির্বিবাদে জারি থাকছে এই পৈশাচিক আচরণ, অথচ, আন্তর্জাতিক স্তরেও সেভাবে নেই প্রতিবাদ!
যদিও, প্রযুক্তির সৌজন্যে বিশ্ব ক্রমে আরও বিভিন্ন উপায়ে বদলে চললেও, সেই বদল যে এই বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে সার্বিকভাবে ঘটছে, তাও নয়। তেমনই, এই বদলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে এই বিশ্বের বাসিন্দাদের মধ্যে সার্বিকভাবে মানসিকতার উন্নয়ন ঘটছে, তাও নয়। সার্বিকভাবে মানসিকতার উন্নয়নও সম্ভব নয়। যে কারণে, বিশ্ব ক্রমে আরও বদলে চললেও, এখনও যে এই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন অংশে কত রকমের পৈশাচিক আচরণ জারি রয়েছে, সেই তালিকাও কম লম্বা হবে না। যে কারণেও হয়তো প্রকাশ্যে গণধর্ষণের খেলার মাধ্যমে পৈশাচিক প্রথা পালনের বিরুদ্ধে এখনও সেভাবে প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারেনি। বরং, এই পৈশাচিক আচরণের প্রসার ঘটছে। এই বিশ্বের এক অংশ থেকে অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়ছে।
তবে, এই পৈশাচিক আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যে উঠছে না, তাও কিন্তু নয়। ফেসবুক, টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যাচ্ছে প্রতিবাদ। আন্তর্জাতিক স্তরের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিবেদন। অথচ, এই প্রতিবাদ যে এখনও তেমন তীব্র আকার নিতে পারেনি, তাও মিথ্যা নয় বলেও প্রকাশ পাচ্ছে। এবং, এমনই বিভিন্ন বিষয় প্রকাশ্যে আসছে আবার প্রযুক্তির সৌজন্যেই। এই প্রযুক্তির সৌজন্যেই আন্তর্জাতিক স্তরের কোনও কোনও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এই পৈশাচিক আচরণের বিষয়টি সম্পর্কে অনেকে জানতে পারছেন।
এই পৈশাচিক আচরণের পোশাকি নাম ‘তাহরুশ জামাই’৷ এই ‘তাহরুশ জামাই’য়ের প্রথা অনুযায়ী, প্রকাশ্যে নারীদের ধর্ষণ করা হয়। সমষ্টিগতভাবে অর্থাৎ, বহু সংখ্যক পুরুষ মিলে বিভিন্ন উপায়ে নারীদের অসম্মান এবং হেনস্তা করার উপায় হিসেবেও পরিচিত ‘তাহরুশ জামাই’। শুধুমাত্র তাই নয় ‘তাহরুশ জামাই’ মানে সমষ্টিগতভাবে নারীদের উপর যৌন নির্যাতন। পৈশাচিক এই প্রথা আসলে প্রকাশ্যে গণধর্ষণ। কারণ, এই প্রথায় নারীদের ধর্ষণের লক্ষ্যে বিশাল সংখ্যক উন্মত্ত পুরুষের যেমন উপস্থিতি থাকে তেমনই, ধর্ষণে অংশগ্রহণকারীদের রক্ষা করার জন্য ঘিরে থাকে বিশাল সংখ্যক পুরুষ। প্রচলিত অর্থে, এই পৈশাচিক আচরণকে বলা হয় গণধর্ষণের খেলা এবং পৈশাচিক এই প্রথা মানুষের খেলা হিসেবে পরিচিত।
মিশর এবং আরব জগতের কোন কোন অংশে এই প্রথার প্রচলন রয়েছে। ওই সব অংশের যুবকদের কাছে ইতিমধ্যেই এক হাজারেরও বেশি নারী ধর্ষণ, যৌন হেনস্তা এবং অসম্মানের শিকার হলেও, এই পৈশাচিক অপরাধ সেভাবে প্রকাশ্যে আসেনি। সাধারণত এই খেলার আসর সেখানেই আয়োজন করা হয়, যেখানে বিশাল সংখ্যক মানুষের জমায়েত হয়। আর প্রতিবাদের নামে সেখানে ধর্ষকদের সুরক্ষাও দেওয়া হয়। সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে, চলতি বছরের শুরুতে এই খেলা ইউরোপেও শুরু হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের সৌজন্যে গত বছরেই প্রথম প্রকাশ্যে আসে, মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন অংশে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চালু রয়েছে পৈশাচিক এই প্রথা। জার্মানিতে চলতি ইংরেজি বছরের নববর্ষের সূচনা অনুষ্ঠানে এই ধরনের পৈশাচিক আচরণের কয়েকটি ঘটনার অভিযোগের ভিত্তিতে, এই বিষয়টি সংবাদমাধ্যমের সৌজন্যে প্রকাশ্যে আসে।
২০১১-য় আন্তর্জাতিক স্তরের সংবাদমাধ্যমের জনপ্রিয় এক নারী সাংবাদিককে যৌন হেনস্তার সময় নগ্ন করে দেয় উন্মত্ত জনতা। শুধুমাত্র অসম্মান এবং যৌন হেনস্তা নয়। উন্মত্ত জনতার গ্রাস থেকে যত সময় সেনাবাহিনী ওই নারী সাংবাদিককে উদ্ধার করতে সমর্থ হয়নি, তত সময় পর্যন্ত তার উপর চলেছিল নৃশংসভাবে মারধর এবং আক্ষরিক অর্থে ধর্ষণ। মিশরের তাহরির স্কোয়ারে, সেখানকার প্রেসিডেন্টের অনুষ্ঠানে সংবাদ সংগ্রহের সময় যেভাবে ওই নারী সাংবাদিককে অসম্মান এবং যৌন হেনস্তার শিকার হতে হয়, তার জেরেই, পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমের সৌজন্যে ধর্ষণের খেলার মতো পৈশাচিক এই আচরণের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
চলতি ইংরেজি বছরের নববর্ষের সূচনা অনুষ্ঠান উদযাপনের সময় জার্মানির কলোনে ‘তাহরুশ জামাই’য়ের মতো পৈশাচিক প্রথা ফের প্রকাশ্যে আসে। এই ঘটনায় যুক্ত থাকার জন্য জার্মানির ওই শহরের মধ্য প্রাচ্যের শরণার্থীদের একাংশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে।
পৈশাচিক এই খেলায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অসম্মান, হিংস্রতা, যৌন হেনস্তা সর্বোপরি ধর্ষণের শিকার হন নারীরা। কীভাবে সংঘটিত হয় পৈশাচিক প্রথার এই খেলা? সাধারণত বিশাল সংখ্যক উন্মত্ত পুরুষের উপস্থিতিতে পৈশাচিক এই খেলা চলে। শিকার হিসেবে যে নারীকে চিহ্ণিত করা হয়, জমায়েত হওয়া উন্মত্ত ওই সব পুরুষের কেন্দ্র স্থলে সেই মহিলার উপর চলতে থাকে বিভিন্ন উপায়ে অসম্মান এবং হিংস্র অত্যাচার। কেন্দ্র স্থলে চক্রাকারে থাকা পুরুষরা ওই মহিলার উপর পৈশাচিক অত্যাচারে অংশ নেয়। ওই সব পুরুষের মধ্যে কে ওই মহিলার উপর কত বেশি হিংস্র হয়ে উঠতে পারে, চলতে থাকে তারও প্রতিযোগিতা। কেন্দ্র স্থলের ওই চক্রকে ঘিরে থাকে অন্য একটি চক্র। ওই মহিলার উপর অত্যাচারের জন্য এই দ্বিতীয় চক্রের উন্মত্ত পুরুষরাও কেন্দ্রীয় স্থলের চক্রে প্রবেশের চেষ্টা করতে থাকে। এ ভাবে অসম্মান, হেনস্তা এবং হিংস্র অত্যাচারের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত গণধর্ষণের শিকার হওয়া ছাড়া ওই মহিলার কাছে অন্য আর কোন উপায়-ও থাকে না। দ্বিতীয় চক্রের বাইরে থাকে আরও একটি চক্র। এই তৃতীয় চক্রের উন্মত্ত পুরুষরা একদিকে যেমন তাদের বাইরে জমায়েত হওয়া বিশাল জনতার থেকে কেন্দ্রীয় স্থল এবং দ্বিতীয় চক্রের উন্মত্ত পুরুষদের সুরক্ষা প্রদান করে৷ অর্থাৎ, ধর্ষকদের রক্ষা করে। তেমনই, তৃতীয় চক্রের বাইরে থাকা বিশাল জনতাকে বিভ্রান্ত করে যে, এই চক্রের পুরুষরা ওই মহিলাকে রক্ষার চেষ্টা করছে।
আন্তর্জাতিক স্তরের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সৌজন্যে এমনই প্রকাশ্যে এসেছে যে, গত বছর ইউরোপের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছে পৈশাচিক এই ধর্ষণের খেলা। অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, ফিনল্যান্ডে-ও এই খেলার ছায়া পড়েছে বলে প্রকাশ্যে এসেছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক স্তরের ওই সব সংবাদমাধ্যমের পক্ষে এমন আবেদনও রাখা হয়েছে, ধর্ষণের এই খেলার বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন অংশের আরও বেশি সংখ্যক মানুষ যখন জানতে পারবেন, তখন তারাও পৈশাচিক এই প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য অংশীদার হয়ে উঠতে পারবেন।
এখনই যদি পৈশাচিক এই প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠার কাজটি শুরু না হয়, তা হলে হয়তো আগামী দিনে দেখা যাবে যে, আমাদেরই কারও পরিচিত কোন মহিলা এই খেলার শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন জাতি তথা দেশের মাধ্যমে বিভক্ত হয়ে রয়েছে এই বিশ্ব। তবে, মানবতার কোন ভাগ হয়নি এবং, জাতি-দেশ ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সেই সব মানুষও রয়েছেন, যাদের মানবতা এখনও নিঃশেষিত হয়ে যায়নি। যে কারণে, পৈশাচিক এই খেলার বিষয়টিকে কোন এক বা একাধিক দেশের সমস্যা মনে না করে, এই বিষয়টিকে গোটা বিশ্বের সমস্যা হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত।
একজন পুরুষ যেভাবে বেঁচে থাকেন, সেই ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার একজন মহিলারও রয়েছে। পুরুষের মতো একজন মহিলারও জন্ম হয়েছে প্রাকৃতিক কারণে। নারীরা যৌনতার কোন খেলনা নয় যে, এ ভাবে তারা প্রথার নামে গণধর্ষণের এক খেলার শিকার হবেন।
বিডি প্রতিদিন/২৭ নভেম্বর ২০১৬/হিমেল