সত্তরোর্ধ দুদু মিয়ার দু'চোঁখ গড়িয়ে পড়ছে পানি। ''তুই ক্যান বন ছাইড়া মরতে আইলি এইহানে-মানুষ তরে চিনলো না''- কান্নার সুরে আহাজারি করছিলেন জমিলা বেগম। শুধু দুদু মিয়া আর জমিলা বেগম নয়, সরিষাবাড়ির কয়ড়া গ্রামের আলমগীর, আবুল কাশেম, ফরহাদ, জবান আলী, কুদ্দুস সবার চোঁখ ছলছল করছিলো। যেন স্বজন হারানোর ব্যথা তাদের বুকে। কিছুতেই তারা মেনে নিতে পারছে না বঙ্গ বাহাদুরের চলে যাওয়াকে। এই অল্প সময়েই সবার আপন হয়ে গিয়েছিল ভারতীয় হাতিটি।
বঙ্গ বাহাদুরের মৃত্যুর পর সরিষাবাড়ির কয়ড়া গ্রাম ও আশে-পাশের গ্রামগুলোতে মানুষের মধ্যে এখন শোকের ছায়া। চায়ের দোকান থেকে ঘরে ঘরে- সর্বত্র আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে 'বঙ্গ বাহাদুর'।
''বন্যায় হাতিটি এই অঞ্চলে আসার পর থেকে আমরা তার পিছে আছি। আনন্দ করেছি। হাতিটি খুব নিরীহ প্রকৃতির ছিল। আমাদের বাড়ি-ঘর নষ্ট করেনি। ফসলের ক্ষতি করেনি। হাতিটির প্রতি আমাদের মায়া জন্মে গিয়েছিল। বলছিলেন দুদু মিয়াসহ এলাকাবাসী।
মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) সকাল সাড়ে ৬টার দিকে মারা যায় বন্য হাতি 'বঙ্গ বাহাদুর'। মারা যাবার পর থেকেই কয়ড়া ও আশে-পাশের গ্রামে চলছে শোকের মাতম।
উদ্ধারকারী দলের সদস্য ডা. সাঈদ হোসেন জানান, সোমবার দুপুরের দিকে হাতিটি অসুস্থ হয়ে পড়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে। এরপর সে আর দাঁড়াতে পারেনি। তার শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল। গতকাল দুপুর থেকে তার চিকিৎসা চলছিল। চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ সকাল সাড়ে ৬টায় বঙ্গ বাহাদুর মারা যায়।
এলাকাবাসীর অভিযোগ বনবিভাগের কর্মকর্তাদের অবহেলায় হাতিটির মৃত্যু হয়েছে। কারণ সোমবার সারাদিন কাঁদাপানিতে মৃতের মতো শুয়ে থাকার পরও উদ্ধারকারী বন কর্মকর্তারা বলেছিলেন, 'হাতিটি বিশ্রাম নিচ্ছে। সে সুস্থ আছে।'' এ ঘটনায় এলাকাবাসী বিক্ষোভ মিছিল করেছে।
তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে বনবিভাগের উদ্ধারকারী দলের প্রধান ডক্টর তপন কুমার দে বলেছেন, আমরা হাতিটিকে বাঁচাতে সব রকম চেষ্টা করেছি। উদ্ধার হবার পর বিরুপ পরিবেশের কারণে আমরা হাতিটিকে নিরাপদ স্থানে সরাতে পারিনি। 'বঙ্গ বাহাদুরকে' নিয়মিত খাবার, স্যালাইন দেওয়া হচ্ছিল। চলছিল চিকিৎসাও। তারপরও আমরা তাকে বাঁচাতে পারলাম না।
বক্তব্য দেওয়ার সময় আবেগে চোঁখ ছলছল করছিল এই কর্মকর্তারও। তিনি জানান, ময়নাতদন্তের পর হাতির মৃত্যুর কারণ জানা যাবে। ময়নাতদন্তের জন্য বনবিভাগের ভেটেনারী সার্জন ডা. মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। মেডিকেল টিমের প্রধান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন হাতিটি চরাঞ্চলে নি:সঙ্গ ছিল। দীর্ঘদিন ঠিকমতো খাবার পায়নি। তাছাড়া অপরিচিত পরিবেশে সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল। সবমিলিয়ে শারীরিকভাবে সে অত্যন্ত দুর্বল ছিল। যে কারণে হার্ট অ্যাটাকে তার মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার বিকেলে ময়নাতদন্ত চলছিল। ময়নাতদন্ত শেষে ভিসেরা রিপোর্টের জন্য ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার মহাখালীতে পাঠানো হবে।
২৬ জুন বন্যার পানিতে ভেসে ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছিল বন্য হাতিটি। এরপর প্রায় দেড়মাস সে জামালপুর, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়ার চরাঞ্চলে ঘুরে বেড়ায়। গত বৃহস্পতিবার ১১ আগস্ট চেতনানাশক দিয়ে হাতিটিকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের পর থেকে সে অস্থির ছিল। কয়েকদফা সে দড়ি ও শেকল ছিড়ে ছুটে গেলে ফের তাকে চেতনানাশক দিয়ে আটক করা হয়।
এদিকে নিরীহ ভারতীয় হাতিটির মৃত্যুতে যেন শোকের মাতম চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও। ফেসবুকে মানুষের আহাজারির পাশাপাশি হাতিটির মৃত্যুর জন্য সংশ্লিষ্ট বন কর্মকর্তাদের অনভিজ্ঞতাকে দায়ী করছেন অনেকে।
বিডি-প্রতিদিন/এস আহমেদ