দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ১ লাখ ৪২ হাজার টনের বিপুল পরিমাণ কয়লা হঠাৎ গায়েব হয়ে গিয়েছে। আর কয়লা সংকটে বন্ধ হয়ে পড়েছে বড়পুকুরিয়া কয়লাচালিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এতে রংপুরের বিভিন্ন জেলায় বিদ্যুৎ সংকটে দুর্ভোগে পড়েছেন সেখানকার মানুষ। কিন্তু এত কয়লা কোথায় গায়েব হয়ে গিয়েছে সে সম্পর্কে কেউই কিছু জানেন না।
এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে খোয়া যাওয়া কয়লার ব্যাপারে পূর্ণ তদন্ত কার্যক্রমের নির্দেশ দিয়েছেন। এজন্য পেট্রোবাংলাকেও মামলা করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এরই মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আর কয়লা গায়েবের ঘটনায় দুর্নীতির প্রাথমিক সত্যতার আলামত মিলেছে বলেও জানিয়েছেন দুদক কর্মকর্তারা।
এমনকি কয়লা খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিব উদ্দিন আহমেদসহ সংশ্লিষ্ট আরও চারজনকে দেশত্যাগ করতে না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ইমিগ্রেশন বিভাগে চিঠিও পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা যায়, বেশ কয়েক বছর ধরে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির কয়লার অবৈধ ব্যবহার ও এর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট গড়ে ওঠেছে। বড়পুকুরিয়ার স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে অন্তত ৩০ থেকে ৪০ জন মানুষ এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জড়িত।
বড় বড় কয়লা ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের অনেকেই আছেন, যারা ক্ষমতাসীন দলীয় লোকজনের সঙ্গে চলাফেরা করেন তারাও এই সিন্ডিকেটে জড়িত। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে কয়লা আন্দোলনকারী ও কয়েকটি দায়িত্বশীলরা এসব কথা জানান।
তারা আরও জানান, কয়লা উত্তোলনের পর সুবিধাভোগীদের অনেকে ইটভাটার নামে ভুয়া ডিও লেটার তৈরি করে আবার প্রকৃত ইটভাটার মালিকরা তাদের চাহিদাপত্র দিয়ে, দায়িত্বশীল মহল যেমন- স্থানীয় মন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীদের কাছ থেকে বিভিন্ন সুপারিশপত্র দিয়ে নিজেদের চাহিদাপত্র অনুযায়ী খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করেন। আবার কয়লা খনির কয়েকজন কর্মকর্তা টাকা খাটিয়ে কয়লা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অবৈধ এই কর্মকাণ্ডে জড়িত আছেন। তবে আপাতদৃষ্টিতে এই বিশাল পরিমাণ কয়লার হদিস বের করা খুব কঠিন ব্যাপার। এ জন্য দীর্ঘদিন সময়ও লাগবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জিটিসি মধ্যপাড়ার কঠিন শিলার এক কর্মকর্তা বলেন, '২০১২-১৩' সালের দিকে আমি নিজেই ভুয়া ১১০টি ডিও হাতে পেয়েছি। আর এই কাজের সঙ্গে কয়লা খনির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু কর্মকর্তা জড়িত ছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত সেই কর্তকর্তাদের চিহ্নিত করা যায়নি।
পরিবেশ ও সম্পদ রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক ও স্থানীয় কয়লা আন্দোলনকারী মশিউর রহমান বুলবুল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখানে সিস্টেম লস কিছু আছে কিন্তু এখানে কয়লা চুরিও গেছে। না হলে এত কয়লার হঠাৎ উধাও হওয়ার কথা নয়। ইতিপূর্বে ৩০০ টন কয়লার (২৭ লাখ টাকার) ঘাপলা ছিল। কিন্তু খনির কর্মকর্তারা তখন নিজেরাই বিষয়টি ধামাচাপা দেয়। আবার খনির কিছু ভুয়া কর্মকর্তার যোগসাজশে কয়লা বোঝাই অনেকগুলো ট্রাকের সঙ্গে লুকানো কিছু ট্রাকে করেও কয়লা পাচার করা হয়।
খনির একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা মাসুদ হাওলাদার এই কয়লা চুরির যোগসাজশের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে ধারণা করছি। ২০১৬ সালে একবার কয়লা সংকট হলে খনি বন্ধের আগে তিনজন ব্যবসায়ীর কাছে ত্রিশ হাজার টন কয়লা বিক্রি করা হয়। এর পরদিনই খনি বন্ধ হয়ে যায়। এই তিন ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে উধাও হয়ে যাওয়া কয়লা সম্পর্কে জানা যেতে পারে।
এমডি-জিএমের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা : বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিব উদ্দিন আহমেদসহ চারজনকে দেশত্যাগ করতে না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ইমিগ্রেশনে চিঠি পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল দুদক থেকে এ বিষয়ে চিঠি পাঠানো হয়। বড়পুকুরিয়া খনির কয়লা উধাওয়ের ঘটনায় তদন্তে গঠিত কমিটি সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
দুদকের ওই চিঠিতে তালিকাভুক্ত অপর ব্যক্তিরা হচ্ছেন-বড়পুকুরিয়া কোল মাইন কোম্পানির এমডি হাবিব খুরশিদ আহমেদ, জিএম (প্রশাসন) আবুল কাশেম প্রধানিয়া, জিএম (কোল মাইনিং) আবু তাহের মোহাম্মদ নুরুজ্জামান চৌধুরী এবং ডিজিএম (স্টোর) এ কে এম খাদেমুল ইসলাম।
তদন্ত কমিটির প্রধান উপ-পরিচালক শামসুল আলম জানান, আমরা তদন্তের প্রয়োজনে যা যা দরকার সব ব্যবস্থাই গ্রহণ করছি।
বিডি প্রতিদিন/২৫ জুলাই ২০১৮/আরাফাত