ঢাকা থেকে মাত্র সোয়া দুই ঘণ্টার ফ্লাইটে চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিং শহর এখন বাংলাদেশের রোগীদের কাছে চিকিৎসার নতুন গন্তব্য হিসেবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। উন্নত প্রযুক্তি, মানসম্মত চিকিৎসা এবং তুলনামূলক সাশ্রয়ী খরচের কারণে ক্যান্সার, হৃদরোগ ও নিউরো সংক্রান্ত জটিল রোগে আক্রান্ত অনেকেই এখন ভারত, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের বিকল্প হিসেবে কুনমিংকে বেছে নিচ্ছেন।
চীন সরকারও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য বিশেষ করে বাংলাদেশের রোগীদের জন্য কুনমিংয়ের স্বাস্থ্যসেবা খাতে আরও প্রসার ঘটানোর উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশি চিকিৎসক ও মেডিকেল ট্যুরিজম সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কুনমিংয়ে চিকিৎসা খরচ অনেক ক্ষেত্রেই ভারতের তুলনায় কম এবং সেবার মানও উন্নত। বিশেষ করে আধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতি, নির্ভুল ডায়াগনস্টিক পদ্ধতি ও চিকিৎসকদের দক্ষতা রোগীদের আস্থা বাড়িয়েছে।
তবে চীনে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীদের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ভাষা। এছাড়া আবাসন, খাবার, সরকারি হাসপাতালে সিরিয়াল পাওয়া, অনলাইন যোগাযোগব্যবস্থা এবং যাতায়াতের খরচ— এই বিষয়গুলোও কিছুটা চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হাসপাতালগুলোতে দক্ষ দোভাষী (ইন্টারপ্রেটার) নিয়োগ এবং অন্যান্য সমস্যার দ্রুত সমাধান করা গেলে কুনমিং ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রোগীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক চিকিৎসাকেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।
গত ২০ জুন কুনমিং মেডিকেল ইউনিভার্সিটি পরিদর্শনকালে দক্ষিণ এশিয়ার সাংবাদিক দলের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন সেখানে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি পিএইচডি গবেষক আরিফিন ইসলাম। তিনি বলেন, এখানে চিকিৎসা খরচ বাংলাদেশের প্রাইভেট হাসপাতালের মতো হলেও সেবার মান অনেক ভালো। চিকিৎসা শুরুর আগে ১০,০০০ ইউয়ান (প্রায় ১,৭৫,০০০ টাকা) ডিপোজিট দিতে হয়। চিকিৎসা শেষে অতিরিক্ত অর্থ ফেরত দেওয়া হয়।
তিনি আরও জানান, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকের পরামর্শ ফি ১৫ ইউয়ান (প্রায় ২৬০ টাকা), যা স্থানীয় ও বিদেশি— সবার জন্যই এক। স্পাইন সার্জারির মতো জটিল অপারেশন ও ১০ দিন হাসপাতালে থাকতে মোটামুটি ১০,০০০ ইউয়ান (প্রায় ১,৭৫,০০০ টাকা) খরচ করলেই চলে। আমরা ইনভাইটেশন লেটার দেওয়ার আগে রোগীকে সম্ভাব্য খরচ জানিয়ে দিই।
২০২৪ সালে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়। এর জেরে ভারত বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা কড়াকড়ি করে দেয়। এর আগ পর্যন্ত ভারতই ছিল বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসার প্রধান গন্তব্য।
বাংলাদেশিরা বিদেশে চিকিৎসার জন্য বছরে কত খরচ করেন, তার নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও গত ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, বাংলাদেশের নাগরিকরা প্রতিবছর ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি ব্যয় করেন বিদেশে চিকিৎসা নিতে। এর বড় অংশই ব্যয় হয় ভারত এবং থাইল্যান্ডে, যেখানে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে উন্নত।
তবে ইন্ডিয়ায় চিকিৎসা সেবা গ্রহণের সুযোগ কমে যাওয়ার পর থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য দেশে বাংলাদেশি রোগীদের ভিড় বাড়তে থাকে। এর মধ্যেই তুলনামূলক সাশ্রয়ী চিকিৎসা সেবার একটি বিকল্প হিসেবে আলোচনায় উঠে আসে চীন।
চলতি বছরের মার্চে বাংলাদেশ ও চীন সরকারের উদ্যোগে বাংলাদেশি রোগীদের একটি প্রতিনিধি দল কুনমিং সফর করে। ৩১ সদস্যের ওই দলে ছিলেন ১৪ জন রোগী, তাদের পরিবারের সদস্য, ডাক্তার, ট্যুর অপারেটর এবং সাংবাদিকরা।
মেডিকেল ট্যুরিজম সংস্থা ট্র্যাক মেডি সার্ভিসেসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ রাশেদুল হাসান বলেন, চীনের চিকিৎসা ব্যয় থাইল্যান্ডের তুলনায় কম, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে ইন্ডিয়ার চেয়েও কম। তবে চিকিৎসা ব্যবস্থা ও সুযোগ-সুবিধা ইন্ডিয়ার চেয়েও উন্নত।
তিনি আরও বলেন, ওদের মেডিকেল টেকনোলজি অনেক হাই এবং লজিস্টিকসও অনেক ভালো। তবে তিনি সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে উল্লেখ করেন ভাষাকে। তার ভাষ্য, বাংলাদেশি রোগী যদি চীনে চিকিৎসা নিতে যান, তাহলে সেখানে ইন্টারপ্রেটার দরকার, যাদের চিকিৎসা সংক্রান্ত বেসিক জ্ঞান থাকতে হবে যেন তারা ডাক্তার ও মেডিকেল স্টাফদের সঙ্গে কার্যকরভাবে যোগাযোগ করতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, সিরিয়ালের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। যদি কাউকে বাংলাদেশ থেকে বিমানভাড়াসহ যাবতীয় খরচ করে গিয়ে সেখানে দুই সপ্তাহ বা এক মাস সিরিয়ালের জন্য অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে সেটি লাভজনক হবে না। তাই ভিসা প্রসেসিং সহজ এবং খরচ কমাতে হবে বলেও তিনি মত দেন।
মেডিকেল ট্যুরিজমের সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে কুনমিংয়ে গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ, থাকা, খাওয়া এবং চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরা— এই পুরো প্রক্রিয়াটি সহজ করা না গেলে কুনমিংয়ের চিকিৎসা সেবা বাংলাদেশের রোগীদের কাছে জনপ্রিয় করে তোলা কঠিন হবে। এক্ষেত্রে এখনো অনেক কাজ বাকি।
তবে তারা জানান, কুনমিংয়ে ক্যান্সার চিকিৎসা অত্যন্ত উন্নত, এজন্য বাংলাদেশের অনেক ক্যান্সার রোগী কুনমিং কিংবা চীনের অন্যান্য প্রদেশের হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ প্রকাশ করছেন।
ঢাকা-ভিত্তিক মেডিকেল ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠান সিওক হেলথকেয়ারের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ২০ জনের বেশি রোগী চীনে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন, যাদের অর্ধেকের গন্তব্য কুনমিং।
সিওক হেলথকেয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এম এম মাসুমুজ্জামান বলেন, খরচ ও চিকিৎসার মান বিবেচনায় চীন বাংলাদেশের রোগীদের জন্য ভালো বিকল্প হতে পারে। কিন্তু প্রধান বাধা হলো ভাষা। এছাড়াও খাবার, আবাসন এবং সিরিয়ালের জন্য সময় পাওয়া নিয়েও কিছুটা সমস্যা রয়েছে।
তিনি বলেন, একজন ক্যান্সার রোগী যদি পিইটি সিটি স্ক্যান করতে চায় এবং তাকে ৭ থেকে ১০ দিন সিরিয়ালের জন্য অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে তার ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে।"
তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইতোমধ্যে বেশ কিছু রোগী চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে এসেছেন এবং তাদের ফিডব্যাক ভালো ছিল বলে জানান তিনি। তার মতে, যেসব বাংলাদেশি শিক্ষার্থী চীনে পড়াশোনা করছেন, তারা চাইলে দোভাষী হিসেবে কাজ করতে পারেন। তবে অবশ্যই তাদের চিকিৎসাবিষয়ক বেসিক জ্ঞান থাকতে হবে।
তবে এসব বাধাকে বড় সমস্যা হিসেবে দেখছেন না ব্যবসায়িক নেতারা। বাংলাদেশ-চীন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. খোরশেদ আলম বলেন, ভবিষ্যতে চীন বাংলাদেশের রোগীদের জন্য চিকিৎসার ভালো বিকল্প হতে পারে।
তিনি বলেন, অনেক বাংলাদেশি আগে থেকেই চীনে থাকেন, তারা দোভাষী হিসেবে কাজ করতে পারবেন। রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলে এই সমস্যা অনেকটাই সমাধান হয়ে যাবে।
তিনি আরও জানান, সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের মত ঢাকায় চীনের হাসপাতালগুলোর সার্ভিস সেন্টার খোলার পরিকল্পনাও রয়েছে, যেন এখান থেকেই যাবতীয় সেবা নেওয়া যায়। সেখানে (চীন) চিকিৎসা ও ওষুধের খরচ কম, কিন্তু চিকিৎসা সেবা ভালো।
কুনমিং মেডিকেল ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন স্কুলের ডিন লাই ইয়াজিয়ে বলেন, এই মুহূর্তে চীন যেভাবে এগিয়ে আসছে, তাতে অনেকেই মনে করছেন এটি বাংলাদেশি রোগীদের জন্য কোয়ালিটি হেলথকেয়ারের একটি বাস্তবসম্মত বিকল্প হয়ে উঠছে।
তিনি কুনমিংকে বাংলাদেশি মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জন্যও একটি সম্ভাবনাময় জায়গা হিসেবে দেখছেন। তার ভাষায়, আমাদের কাছে বাংলাদেশের অসাধারণ কিছু শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের ভবিষ্যৎ শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, চীনের জন্যও উজ্জ্বল।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কুনমিংয়ে বাংলাদেশি রোগীদের জন্য যেসব হাসপাতাল প্রস্তুত রয়েছে, সেগুলো হলো— দ্য ফার্স্ট পিপলস হসপিটাল অব ইউনান প্রভিন্স, দ্য ফার্স্ট অ্যাফিলিয়েটেড হসপিটাল অব কুনমিং মেডিকেল ইউনিভার্সিটি, ফুওয়াই ইউনান হসপিটাল অব দ্য চাইনিজ অ্যাকাডেমি অব মেডিকেল সায়েন্সেস এবং ট্রাডিশনাল চাইনিজ মেডিকেল হসপিটাল। এর মধ্যে তিনটি হাসপাতাল সরকারিভাবে পরিচালিত।
সৌজন্যে : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড