একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারকে 'প্রবাসী সরকার বা মুজিবনগর সরকার' বলা ঠিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন মুক্তিযুদ্ধকালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম কেবিনেট সেক্রেটারি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম।
গত রবিবার সন্ধ্যায় নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের পালকি পার্টি সেন্টারে ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব’র ৮৫তম জন্ম বার্ষিকীর আলোচনা সভায় তিনি একথা বলেন। বঙ্গমাতা পরিষদের যুক্তরাষ্ট্র শাখার এ শুধী সমাবেশের আয়োজন করে।
এইচ টি ইমাম বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি নারীদের ত্যাগ-তিতিক্ষার কোন তুলনা হয় না। নিজেদের জীবন বিপন্ন জেনেও তারা মুক্তিবাহিনীকে খাবার দিয়েছেন, সমূহ বিপদের সময় আঁচলের নীচে ঠাঁই দিতেও কার্পণ্য করেননি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন নারী রাজাকারও খুঁজে পাওয়া যায়নি। অথচ নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন অসংখ্য’।
তিনি বলেন, ‘এটি বলার অবকাশ রাখে না যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সমগ্র জনগোষ্ঠির সম্পৃক্ততা ঘটেছিল। শুধুমাত্র সেনাবাহিনী অংশ নেয়নি। ছাত্র-শ্রমিক, কৃষক, চাকরিজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী সর্বস্তরের মানুষ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর ডাকে। এমনকি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের অবদানও অপরিসীম।’
এইচ টি ইমাম মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃত তথ্য উপস্থাপনকালে আরো বলেন, ‘অনেকে এম এ জি ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের সুপ্রিম কমান্ডার হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। এটি সত্য নয়। প্রকৃত সত্য হচ্ছে জেনারেল এম এ জি ওসমানী ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং সুপ্রিম কমান্ডার ছিলেন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কারণ, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সমগ্র জনগোষ্ঠি তারই নামে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধ বলাই সমীচীন হবে।’
এইচ টি ইমাম আরেকটি ব্যাপারে সংশোধনী দেন যে, ‘অনেকে ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। প্রকৃত সত্য হচ্ছে একাত্তরের ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ এর ঘোষণাপত্র পাঠের সময় থেকে তা কার্যকর হয় ২৬ মার্চ প্রথম প্রহর থেকে।’ এটাকে ‘মুজিবনগর সরকার’ বলেও অভিহিত করতে চান অনেকে। সেটিও সত্য নয়। সেটি ছিল ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।’ মুজিবনগর বললে সে সরকারের গণ্ডিকে খাটো করা হয়’।
প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধকালিন পূর্ণাঙ্গ একটি সরকারকে কেউ কেউ ‘প্রবাসী সরকার’ বলেও আখ্যায়িত করছেন। এটিও ভুল। কারণ, একাত্তরের ২৬ মার্চ জনযুদ্ধ শুরুর পর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হওয়ার আগে অনেক এলাকা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে অথবা সেগুলো মুক্ত এলাকা ছিল। তাই প্রবাসী সরকার বলাও ঠিক নয়’।
এইচ টি ইমাম উল্লেখ করেন, ‘জাতির পিতা ১৯৪৮ সাল থেকে সব আন্দোলন-সংগ্রামে বাঙালি জাতিকে নেতৃত্ব দেন। গোটা জাতিকে ধাপে ধাপে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করেন। এভাবে ১৯৬৬, ’৬৮, ’৬৯ -এর পথ বেয়ে সত্তরের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ বিজয় অর্জন করে।’
তিনি বলেন, ‘জাতির পিতার স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র জারির মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। জাতির পিতাকে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি করে সরকার গঠিত হয়। স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর দেখানো হয়। এই সরকারই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন।’
জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত ড. এ কে আব্দুল মোমেন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন। এ সময় রাষ্ট্রদূত মোমেন এইচ টি ইমামকে বাংলাদেশের জীবন্ত ইতিহাস হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ার কাজ অত্যন্ত সুন্দরভাবে শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু অনেকে সেটি উল্লেখ করেন না। শুধু নেগেটিভ প্রচারণা চালানো হয়েছে সে সময়। যারা স্বাধীনতা চায়নি, তাদের দ্বারা এখনও নেতিবাচক প্রচারণা চলছে কোন কোন মিডিয়ায়।
সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি ডা. এনামুল হক এবং সঞ্চালন করেন সাধারণ সম্পাদক আশরাফুজ্জামান। এ সময় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এ কে এ মোমেন, নিউইয়র্ক মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নূরনবী কমান্ডার, বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক সভাপতি কামাল আহমেদ, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নেতা আব্দুর রহিম বাদশা, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, শাহীন আজমল, সিরাজউদ্দিন সোহাগ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। শুরুতে শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকের নৃশংসতার শিকারদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।
বিডি-প্রতিদিন/১১ আগস্ট, ২০১৫/মাহবুব