একটি সময় ছিল প্রবাসীদের নিয়ে দেশের মানুষ ভিন্ন মতে ভাবতেন! দূর দেশে মানুষ ঘামঝরা শ্রম দিয়ে যায়, বয়স বাড়ায়। অথচ সেই ধারণার একেবারেই ব্যতিক্রম চিত্র দিনে দিনে ফুটে উঠছে প্রবাসীদের কর্মকাণ্ডে। এখন যেমন দূরপ্রবাসে বসে বই-পুস্তক লেখার পাশাপাশি রং তুলির আছড়ে দারুণ দারুণ শিল্পকর্ম উপহার দিচ্ছেন অসংখ্য চিত্রশিল্পী। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল আইন প্রবাসী জাহেদুর রহমান রবিন তেমনি একজন তরুণ। ছবি আঁকাই যার নির্মল বিনোদন। চিত্রকর্ম প্রসঙ্গে রবিন বললেন, ‘আঁকাআঁকি শুধু শিল্প নয় বরং একাকীত্ব কাটানোর একটি ভালো উপায়। ছবি আঁকতে গিয়ে আমি পাচ্ছি এক নির্মল বিনোদন। ছবি আঁকা আমাকে সৃজনশীলতা অনুশীলনেও সুযোগ করে দিচ্ছে।’
দূর পরবাসে কর্ম যজ্ঞের মধ্যেও রবিনের অবসর কাটে রং তুলির সংস্পর্শে। নিত্যব্যস্ততার সঙ্গে বর্তমানে আলাদাভাবে যোগ হয়েছে বইমেলার প্রস্তুতি। এঁকেছেন সাংবাদিক ও প্রসিদ্ধ লেখকদের পনেরটিও বেশি বইয়ের প্রচ্ছদ। সম্প্রতি তার আঁকা অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতির একটি প্রোট্রেট ঝুলানো হয় আমিরাতের রাজধানী আবুধাবীর জায়েদ ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। আবুধাবী জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ওই চিত্রকর্মটি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সংগ্রহ করেন এবং এর পরপরই আমিরাত সরকার থেকে মিলে রবিনের শিল্পীর স্বীকৃতি।
রবিন জানান, ‘চার বছরেরও বেশি সময় ধরে ইউএইতে আছি। চাকরি করি সাড়ে ১০ ঘণ্টা। যেটুকু সময় অবসর পাই, ছবি আঁকাতেই তা চলে যায়। কর্ম ব্যস্ততার মাঝেও ইতোমধ্যে ১৫টি বইয়ের প্রচ্ছদ শেষ করতে পেরেছি। তবে এখনো হাতে আরো বেশ কিছু কাজ বাকি আছে। আনন্দের খবর হচ্ছে, কিছুদিন আগে আমার আঁকা একটি ছবি আবুধাবীর জায়েদ ন্যাশনাল মিউজিয়ামে স্থান পায়। বিশ্বের অনেক বড় বড় শিল্পীদের আঁকা ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আমি নবম হই। আমিরাত সরকার তাই আমাকে শিল্পীর মর্যাদা দেয়। আগে ওয়ার্কার ভিসা থাকায় প্রদর্শনীর সুযোগ ছিল না। কিন্তু এবার ভিসা পরিবর্তন করে শিল্পী হিসেবে ভিসা লাগাতে পারবো। এতে শিল্পকর্মের প্রদর্শনীতেও একটা সম্ভাবনা তৈরি হলো।’
কথায় কথায় রবিন ফিরে যান অতীতে। বললেন, ‘ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল চারুকলায় পড়ার কিন্তু পরিবার মনে করত চারুকলায় পড়লে সর্বনাশ হবে, তাই অভিমানে আঁকাআঁকি ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রবাসে আসার পর নিজের একাকীত্ব দূর করতে আবার রং-তুলি হাতে নিই। এখন নিজের অনুভূতিগুলো রং দিয়ে ব্যাখ্যা করি, ভাষান্তর করি। দেশের নানামুখী মানুষের জীবন আমাকে অনুপ্রেরণা জোগায়। আমি সেগুলো খুব অনুভব করি, তারা আমাকে ভাবায়।’
কি আঁকতে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন? এমন একটি প্রশ্নের জবাবেও রবিন জানান, ‘আমি মানুষ আঁকতে বেশি পছন্দ করি। মানুষের বৃদ্ধা সময়। কারণ, সব শিল্পীরই ছবি আঁকার একটি বিষয় থাকে। নির্বাচিত ওই বিষয়টি শিল্পীর ছবি আঁকার গতিসঞ্চার করে। আঁকার উপকরণ হিসেবে তাই আমি মানুষকেই বেছে নিয়েছি। আমার গতি মানুষকে নিয়ে, অন্তরে ও বাইরে যা সমান তালে আমাকে ও আমার শিল্পকে জাগিয়ে রাখছে।’
যেকোনো মানুষের প্রায় সমদর্শনীয় মুখচ্ছবি এঁকে ফেলার অদম্য প্রতিভার অধিকারী রবিন এ পর্যন্ত এঁকেছেন ৭ শতাধিক চিত্রকর্ম। বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্ত্ব, দেশের বরেণ্য নেতা, বিখ্যাত খেলোয়াড় থেকে শুরু করে প্রিয় তারকাদের মুখ সবই এঁকেছেন তিনি। এছাড়াও রবিনের তুলিতে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের প্রকৃতি, বৃদ্ধ কৃষক, অপেক্ষারত কোন বৃদ্ধা, পাহাড়ের কোলে বেড়ে ওঠা বালিকা, দরিদ্র কোনো নারী কিংবা ক্ষুধার্ত এক শিশু। রবিনের আঁকা ছবিগুলোর মধ্যে খুব কমই আছে যা প্রশংসা পায়নি। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে চলছে তার রঙ-তুলির সঙ্গে সংসার। আমিরাতের বড় বড় হোটেল, ধনীদের বাড়ি কিংবা বিভিন্ন বড় অফিসে শোভা পাচ্ছে রবিনের পেইটিং। এমনকি বিদেশিদের হাত ধরে তার চিত্রকর্ম এখন পৌঁছে যাচ্ছে দেশ হতে দেশে।
উল্লেখ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার জাফরপুর গ্রামে রবিনের জন্ম। তিন বোনের একমাত্র ভাই রবিনের বাবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা।
বিডি-প্রতিদিন/৩১ জানুয়ারি, ২০১৬/মাহবুব