শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিক সম্প্রীতি বিপন্নের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। বর্ণবিদ্বেষ, ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষমূলকভাবে উগ্রপন্থি শ্বেতাঙ্গরা গত কয়েক বছরে অসংখ্য হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের টার্গেট করে এসব হত্যাকাণ্ডকে ‘অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
বুধবার (৮ মে) কংগ্রেসে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কমিটির আড়াই ঘণ্টার শুনানিতে এমন প্রশ্নবানে জর্জরিত হয় এফবিআই, বিচার বিভাগ এবং হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা। সংবিধান প্রদত্ত বাক স্বাধীনতা এবং চরমপন্থা দমনে সংশ্লিষ্টরা কতটা মনোযোগী-সে বিষয়েও জানতে চান কংগ্রেসম্যানরা। এমনকি এহেন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঠেকাতে এফবিআই, বিচার বিভাগসহ অন্যান্য সংস্থা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে কীভাবে কাজ করছে সেটিও প্রশ্নের উদ্রেক করেছে এই শুনানিতে।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জুইশ সম্প্রদায়ের আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘এন্টি- ডিফামেশন লীগ’র গবেষণা জরিপে উদঘাটিত হয় যে, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ১০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে চরমপন্থিদের হাতে ৪২৭ জন খুন হয়। এরমধ্যে ৭৩.৩% হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী হচ্ছে ডানপন্থি চরমপন্থিরা।
সাম্প্রতিক সময়ে শ্বেতাঙ্গ-চরমপন্থিদের উস্কানিমূলক তৎপরতা চলছে অনলাইনে তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। শুনানির সময় নিউইয়র্কের কংগ্রেসম্যান (ডেমক্র্যাট) ক্যাথলিন রাইস মন্তব্য করেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এ ধরনের হত্যাযজ্ঞে লিপ্তরা ফেসবুকের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছে তাদের মতলবের কথা। সামাজিক অস্থিরতা তৈরির হুমকি। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের সাথে যুদ্ধ ঘোষণার ইঙ্গিত। ফেসবুকের এসব অপতৎপরতা কারো অজানা নেই। বাক স্বাধীনতার নামে ওরা জনজীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। ২০১৪ সাল থেকে সংঘটিত অন্তত ৪টি গণহত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এই চরমপন্থিদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে অথবা তাদেরকে সন্দেহ করা হচ্ছে। এই অবস্থায় আমাদেরকে একটি কর্মপন্থা অবলম্বন করতে হবে উগ্রপন্থিদের আইনের আওতায় আনার। বিচারে সোপর্দ করার।
গতমাসে সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি সিনেগগে বন্দুকধারী হামলা চালায়। অনলাইনে আগাম ঘোষণা দিয়ে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলকভাবে হামলা করা হচ্ছে। এর ফলে সর্বসাধারণের মধ্যেও প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চরমপন্থিরা এ্যাকশনে নেমেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ তা দেখেও না দেখার ভান করে আছে, যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নিউজিল্যান্ডের মসজিদে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ডের পরই সিনেগগে হামলার আগাম ঘোষণা দিয়ে চরমপন্থিরা গুলিবর্ষণ করেছে। পিটসবার্গে আরেকটি সিনেগগে বন্দুক হামলা হয়েছে।
শুনানিতে অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রদত্ত প্রথম সংশোধনীর কারণে সরাসরি কোনও ব্যক্তি অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিরুদ্ধে তারা কঠোর পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হচ্ছেন না। তবে ইতিমধ্যেই ফেসবুকসহ বেশ কটি টার্মিনালের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে এ নিয়ে তারা কথা বলেছেন। জনজীবনে অশান্তি ডেকে আনে অথবা সামাজিক-জীবনে অস্থিরতা সৃষ্টি করে-এমন তৎপরতা ফেসবুকসহ কোনও মাধ্যমেই কাম্য নয়। উগপন্থি তৎপরতার কোনও কিছু দেখা গেলেই যেন তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের গোচরে আনেন সেটিও বলা হয়েছে বলে এফবিআইসহ কর্মকর্তারা কংগ্রেসকে অবহিত করেছেন।
হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মন্ত্রণালয়ের প্রিন্সিপাল ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি (ইন্টেলিজেন্স এ্যান্ড এনালাইসিস) ব্রায়ান মারফি এ সময় বলেন, ‘ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের শীর্ষ কর্মকর্তাগণের সঙ্গে বৈঠকের সুফলও আসতে শুরু করেছে। তবে আরও অনেক কিছু করার আছে সবকিছুকে ঠিকমত নিয়ন্ত্রণে।’
টুইটারের একজন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ইতিমধ্যেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রচনা করেছে। এ অবস্থায় এফবিআইসহ বিভিন্ন সংস্থা যদি টুইটারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়, কিংবা কোনও তথ্য জানতে চায়, তাহলে কোনও সমস্যাই থাকবে না। সবকিছু তারা জানতে পারবেন। যেকোনও সহায়তা টুইটার দিতে বদ্ধপরিকর। সামাজিক অথবা জাতীয় পর্যায়ে হুমকি সম্বলিত যেকোনও কিছু টুইটারে পোস্ট করার সাথে সাথে তারা জানতে সক্ষম হবেন। কে করছেন, কোথা থেকে করা হচ্ছে বা পরিচালনা করা হচ্ছে-কোনকিছুই অজানা থাকবে না।
টুইটারের এই কর্মকর্তা আরও উল্লেখ করেন, তারা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন নতুন প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটাচ্ছেন জনজীবনের বিরুদ্ধে করতে উদ্যত সবকিছুকে থামিয়ে দিতে।
গুগল এবং ফেসবুকের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনও বক্তব্য আসেনি চলমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে।
এফবিআইয়ের কাউন্টার টেররিজম বিষয়ক সহকারী পরিচালক মাইকেল ম্যাকগ্যারিটি বলেছেন, অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসের ৮৫০টি ঘটনার তদন্ত করছে এফবিআই। এর অর্ধেকই সরকার বিরোধী হিসেবে মনে করা হচ্ছে। ৪০% হচ্ছে বর্ণবিদ্বেষমূলকভাবে উগ্রপন্থিদের হামলার ঘটনা। আর এসবের নেপথ্যে রয়েছে শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থিরা।
ম্যাকগ্যারিটি আরও উল্লেখ করেন যে, গত ৪/৫ বছরে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে যতগুলো সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে তা ইন্টারনেটে প্রচারণার মধ্য দিয়েই হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেও অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসের আস্কারা আসছে অনলাইনে। এককভাবেই হামলা করা হচ্ছে মসজিদ, সিনেগগ অথবা চার্চে। অনলাইনে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমেই মদদ পাচ্ছে হামলাকারী চরমপন্থিরা।
গ্লোবাল টেররিজম ডাটাবেস অনুযায়ী ইউরোপ, নর্থ আমেরিকা এবং অষ্ট্রেলিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থিদের বর্বরতা চরমে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্র বিচার বিভাগের পক্ষে এই শুনানিতে অংশ নিয়ে ডেপুটি এ্যাস্ট্যিান্ট এটর্নি জেনারেল ব্র্যাড ওয়েগম্যান উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এসব শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থিদের ‘অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে অভিহিত করার ঘটনায়।
বিডি প্রতিদিন/কালাম