বুধবার, ১৮ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধু সমগ্র মানবতার সৌন্দর্য

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, ভারত

বঙ্গবন্ধু সমগ্র মানবতার সৌন্দর্য

সেই সময় আমেরিকার সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার বারবার ঘোষণা করেছিলেন- আমেরিকার বিদেশনীতি ভারতের এক ‘মহিলার’ হাতে পরাস্ত হয়েছে। আমরা এর প্রতিশোধ নেব...

 

‘আজি হতে শতবর্ষ পরে

কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি

কৌতূহল ভরে

আজি হতে শতবর্ষ পরে॥’

 

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের এ উক্তিটি স্মরণ করছি কারণ বাংলার এক রবীন্দ্রশিষ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ছিল গেল ১৭ মার্চ। তাঁর বিশাল কর্মকান্ড তাঁর জন্মশতবর্ষে কেউ মনে রেখেছ কিনা সেই কৌতূহল মনে জাগছে। তাই বিশ্বকবির ভাবকে অনুসরণ করে বলতে ইচ্ছা করছে-

‘আজ, শতবর্ষ পরে তোমরা কেউ

করবে স্মরণ আমার সংগ্রাম

স্বাধীনতার তরে।

শুধু আমাকে নয়, যে শত শত প্রাণ

স্বাধীনতার তরে হয়েছে বলিদান

তাদেরও শ্রদ্ধা জানানোর আজ এসেছে

                           সেই শুভক্ষণ।’

শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন অন্যায়ের প্রতিবাদ করে গেছেন। শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। একজন মানুষকে সবচেয়ে সুন্দর মনে হয় যখন তিনি স্বদেশের, স্বজাতির অধিকারের জন্য লড়েন, আপামর জনসাধারণের স্বাধীনতার জন্য, মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেন, এ শুধু একজন মানুষের সৌন্দর্য নয়, একজন নেতার সৌন্দর্য নয়। সমগ্র মানবতার সৌন্দর্য। কারণ একজন মানুষের মধ্য দিয়েই কখনো কখনো সমগ্র মানবতার প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। একজনই তখন হয়ে ওঠেন সামগ্রিক ব্যক্তিত্বের প্রতিনিধি।

মনে হয় রবীন্দ্রনাথের সেই প্রত্যাশিত, প্রতীক্ষিত নেতাই ছিলেন বঙ্গবন্ধু। পুরো স্বদেশকে তিনি অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাঁর কথায়, চিন্তায়, কর্মে পুরো দেশের বাস্তবতার প্রতিফলন দেখেছিল এ দেশের মানুষ। তাই পুরো দেশের মানুষ তাঁর মধ্যে নিজেদের নেতাকে খুঁজে পেয়েছিল।

বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব। এ স্বাধীনতা আনার জন্য বঙ্গবন্ধু সঙ্গে পেয়েছিলেন এমন এক গুণীজনকে যিনি রবীন্দ্রনাথের স্নেহচ্ছায়ায় শিক্ষা এবং আদর্শ লাভ করেছিলেন তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথের প্রিয়দর্শিনী ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এ দুজনের মৃত্যু যেন একই সূত্রে গাঁথা। দুজনই বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু একই দিনে সপরিবারে হত্যাকারীদের হাতে মারা যান আর ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর আগে মৃত্যু হয় তার ছোট পুত্র সঞ্জয় গান্ধীর এবং ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর দক্ষিণ ভারতের শ্রীপেরামবুদুরে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে তাঁর বড় পুত্র রাজীব গান্ধী আতঙ্কবাদীদের হাতে নিহত হন বীভৎসভাবে।

ইতিহাসের পাতায় বারবার ফিরে আসবে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট দিনটি, যেদিন বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছিলেন সপরিবারে। আর ইন্দিরা গান্ধী নিহত হয়েছিলেন ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর। দুজনের হত্যাই তাদের নিজ নিজ বাড়িতে। এখানেও তাদের একটা মিল আছে। ভারত স্বাধীন হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট আর তার এক দিন আগে ১৪ আগস্ট জন্ম হয় পাকিস্তানের। ব্রিটিশদের কাছে পাকিস্তান স্রষ্টা মুহম্মদ আলী জিন্নাহর দাবি ছিল- দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করা। ব্রিটিশরা তা মেনে নিয়ে উসকানি দিয়েছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ঘুরেফিরে ভারতের বর্তমান শাসক দল জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব মেনে নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল, মুজিব থেকে ইন্দিরা গান্ধী- দুজনই ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর অহিংস মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন।

এ দুজনের মৃত্যুর নেপথ্যে কাজ করেছে আমেরিকা ও পাকিস্তান। বাংলাদেশের এক কোটি মানুষকে ইন্দিরা গান্ধী যখন আশ্রয় দিয়েছিলেন তখন পাকিস্তানি খান সেনারা পূর্ব বাংলায় ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল, আর বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে ১৯৭১ সালে দেখেছিল সেই নিপীড়ন, অত্যাচার, ধর্ষণ ও নানা অসামাজিক কাজ। পাকিস্তান জন্মলগ্ন থেকেই বাঙালিদের দাবিয়ে রাখার জন্য সব রকম ষড়যন্ত্র করেছে। মুসলিম লীগের ছাত্রনেতা হিসেবে টুঙ্গিপাড়ার মুজিবুর রহমান মুসলিম ছাত্রদের নিয়ে অবিভক্ত বাংলায় নানা সংগঠন গড়ে তোলেন। পরে তাঁর সব আশা ভঙ্গ হয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের এক সভায় যখন বলেছিলেন-  URDU SHALL BE A STATE LANGUAGE IN PAKISTAN. তখন বাঙালি ছাত্ররা চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে বললেন- না, না, বাঙালিরা সংখ্যাধিক্য তাই আমাদের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা, উর্দু নয়। আর সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আইনের ছাত্র মুজিবুর রহমান। তিনি জিন্নাহর মুখের ওপর বলে দিয়েছিলেন, আমরা উর্দু মানি না। বাংলাকে করতে হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।

যাই হোক, সেই ১৯৫২ সালে শুরু হয় ’৭০ সালের পাকিস্তান সংসদের নির্বাচন পর্যন্ত। এ নির্বাচনে মুজিবের আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। বেঁকে বসে তখন পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান। মুজিবের দাবি মানতে তিনি নারাজ হন, অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না। তাই মুজিবের ডাকে পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অসহযোগ করে। ব্যাংক, বিমান, আদালত সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই সংগ্রামকে মুজিব ৭ মার্চের বক্তৃতায় বলেছিলেন, এটা স্বাধীনতার সংগ্রাম। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বিশ্ববাসী মুজিবের পক্ষে দাঁড়ায়। আর তাঁর পাশে দাঁড়ান মুজিবের বন্ধু ইন্দিরা গান্ধী। ৩০ লাখ মানুষের রক্তে যখন পদ্মা-মেঘনার জল লাল হয়ে যায় তখন আমেরিকা ইয়াহিয়া খানকে অস্ত্র সরবরাহ করে যায় বাঙালি নিধনের জন্য। ইয়াহিয়া মুজিবকে বন্দী করে পাকিস্তান জেলে নিয়ে যায়। তাঁর ঘনিষ্ঠ চার নেতাসহ এক কোটি লোক ভারতে আসেন। মুজিব এরপর পাকিস্তান জেল থেকে বেরিয়ে এসে ঢাকার জনসভায় বলেছিলেন- ‘আমার এবং আমার সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে।’ সে সময় আমেরিকার সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার বারবার ঘোষণা করেছিলেন- আমেরিকার বিদেশনীতি ভারতের এক ‘মহিলার’ হাতে পরাস্ত হয়েছে। আমরা এর প্রতিশোধ নেব। তারা প্রতিশোধ নিয়েছিল। দুই পরিবারের সবাইকে হত্যা করে। বাংলাদেশের এক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান ও মুজিব মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদকে তারা সঙ্গে পেয়েছিল। এটা উপমহাদেশের এক দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হয়ে পাকিস্তানের ইসলামিক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। সেখানে সৌজন্যের তাগিদে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানান। ভুট্টো সফর করে ফিরে যাওয়ার পর ঢাকা সফরে আসেন হেনরি কিসিঞ্জার। তখন ঢাকায় নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ডেভিড ফস্টার। সেই নৈশভোজে জিয়াও আমন্ত্রিত ছিল, ছিল খন্দকার মোশতাক আহমদ। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের মুখে শোনা- ডেভিড ফস্টার বলেছিলেন, বাংলাদেশে একটি সামরিক সরকার গঠন করা দরকার। জিয়া ও খন্দকার ঘাড় নেড়ে বলেছিল, আমরাও তাই চাই। তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে বলেছিলেন, তিনি চান তাকে আমন্ত্রণ করা হোক। কিন্তু তাকে আমন্ত্রণ করা হয়নি। আমন্ত্রণ করা হলে তিনি জানতে চাইতেন- কেন ৩০ লাখ লোককে  হত্যা করার জন্য আমেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য করেছিল, এই কথাগুলো যখন তাজউদ্দীন আমাকে বলছিলেন তখন তাঁর দুই চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। তিনি চোখ মুছতে মুছতে আমাকে বলছিলেন- ‘সুখরঞ্জন বাবু, আমরা সবাই মারা যাব। যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলাম তা ভেঙে চুরমার। আমরা কেউ বাঁচব না।’ তাঁর আশঙ্কাই ষোলোআনা মিলে গেল।

৫০ বছর আগে বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধে কী ঘটেছিল ভারতের একজন সাংবাদিক হিসেবে দেখেছি, শুনেছি। মুক্তিবাহিনী থেকে যৌথবাহিনী, মুজিববাহিনী- প্রভৃতি বাহিনী কীভাবে পাকিস্তানমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলেছিল সেই ইতিহাস নিয়ে পর্যালোচনা করার আগে একবার ফিরে তাকাই সেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের দিকে। সেদিনের অভিশপ্ত রাতে যে ঘটনা ঘটেছিল সে ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর বন্ধু ইন্দিরা গান্ধীর বাড়িতে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। ইন্দিরাপুত্র সঞ্জয় গান্ধী এবং তাঁর স্ত্রী মেনকা গান্ধীর সঙ্গে ১৯৭৭ সালে আমেথিতে একটি বাংলোতে বসে আমি শুনেছি। ওরা আমাকে জানাল- খবরটি যখন ২নং সফদরজং রোডের বাড়িতে পৌঁছল তখন গভীর রাত্রি। মাম্মি অর্থাৎ ইন্দিরাজি তখন রাতের পোশাকে। তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে লনে ছোটাছুটি করছেন আর কাঁদছেন। তিনি আমাদের জড়িয়ে ধরে বললেন- ‘এখনই ধাওয়ানকে ডাকো। মন্ত্রীদের ডাকো, মুজিব ভাই নেই। মুজিব ভাই নেই। মুজিব ভাইকে বারবার সতর্ক করেছিলাম। উনি আমার কথা শোনেননি। সেই রাতে মাম্মিকে আমরা থামাতে পারছিলাম না।’

নেই, মুজিব ভাই নেই একই কথা বারবার বলে যাচ্ছিলেন, কিছুক্ষণ পর ধাওয়ান এসে পৌঁছলেন। এলেন বিদেশ সচিব জগৎ মেহেতা, এলেন সামরিক বাহিনীর প্রধান শ্যাম মানেকশ। মাম্মি তাদের বললেন- আপনারা কী করেছেন? আপনারা তো জানতেন, এ ধরনের একটা খবর আমাদের কাছে ছিল। এলেন ‘র’-এর প্রধান রামনাথ কাউ। কাউকে মাম্মি ধাক্কা দিয়ে বললেন- তোমরা কী করেছ? কাউ উত্তরে বললেন- আমরা গতকালও বঙ্গবন্ধুকে বার্তা দিয়েছিলাম। তাঁকে ওই বাড়ি ছাড়তে বলেছিলাম, তিনি আমাদের কথা শোনেননি। যাই হোক ভোর হওয়া পর্যন্ত কেউ থামাতে পারেনি, মাম্মিকে দেখে মনে হচ্ছিল তাঁর সহোদর ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছি প্রবীণ মন্ত্রীরা মাম্মিকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। তখন বিদেশমন্ত্রী ছিলেন ওয়াই-বি চ্যাবন। চ্যাবন সাহেব ইন্দিরাকে বললেন- কয়েক মাস আগে ঢাকায় গিয়ে আমি বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করে এসেছিলাম। কিন্তু তিনি এতই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, আমাকে বলেছিলেন- আমি জাতির পিতা আমাকে কেউ মারবে না, আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। তাঁকে মারার জন্য জিয়া-খন্দকার জুটি আমেরিকা ও পাকিস্তানের সঙ্গে সব রকম নীলনকশা তৈরি করেছিল। এ কথাও আপনাকে ও বঙ্গবন্ধুকে জানানো হয়েছিল। ইন্দিরা বিদেশ সচিবকে জিজ্ঞেস করলেন- আমাদের হাইকমিশনার কোথায়? তাকে ডাকো, জগৎ মেহেতা তাঁকে জানালেন বিদেশ সচিব ছুটিতে কলকাতায় আছেন। ঢাকার সঙ্গে সব রকম যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন। ভোর হতে না হতেই বিরোধী দলের নেতারা যেমন- ভূপেশ গুপ্ত, ত্রিদিব চৌধুরী এবং জনসংঘের নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ি ইন্দিরার বাড়িতে তাঁকে সান্ত্বনা দিতে আসেন। মাত্র চার বছর আগে যে দেশটি স্বাধীন হয়েছে, যিনি সেই স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে এরকম জঘন্যভাবে হত্যা আমরা মেনে নিতে পারি না, এর ফল তাদের পেতে হবে। বাঙালিরা চার বছর আগে যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে, সেই বাঙালিরাই একদিন পাকিস্তান ও আমেরিকাকে উচিত শিক্ষা দেবে। যে কোনো হত্যাই নিন্দনীয়, এক্ষেত্রে কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়েছে। পাঁচ বছরের মাথায় চট্টগ্রামে আর এক জেনারেলের হাতে জিয়া নিহত হন, তখন ইন্দিরা গান্ধী পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন। ১৯৭৭ সালে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর ১৯৮০ সালে তিনি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসেন। মৃত্যুর আগে জিয়া সামরিক পোশাকের ওপর একটা আলখাল্লা পরে বেসামরিক অর্থাৎ সিভিলিয়ান হয়ে গেলেন। তিনি একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। দলের নাম দেওয়া হয় বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টি। যা এখন বিএনপি নামে পরিচিত। বাংলাদেশের অধিকাংশ মুক্তিবাহিনীর নেতারা মনে করেন- জিয়ার মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সামরিক বাহিনীর সাহায্যে ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসেন। এ ব্যাপারে বিস্তারিত যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু হত্যায় কলকাতায় কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা বলা দরকার।

কলকাতায় ভোর ৫টায় স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ভারপ্রাপ্ত গোয়েন্দা অফিসার শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায় আমাকে ফোনে ওই দুঃসংবাদটি দিলেন। আমি দ্রুত রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। কলকাতায় বাঙালিরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে শোক প্রকাশ করেছে। জিয়া-খন্দকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছেন ‘মুর্দাবাদ’ বলে।

আবার ফিরে যাই সেই অভিশপ্ত রাতের কথায়। ইন্দিরা গান্ধী ইতিমধ্যে খবর পেলেন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা (বর্তমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী) ও রেহানা এবং তাদের স্বামী-সন্তানরা জার্মানির সাবেক রাজধানী ‘বন’-এ একটি হোটেলে আছেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে জার্মানিতে ভারতের রাষ্ট্রদূতকে ফোন করে বললেন, ওদের হোটেল থেকে আপনার বাসভবনে নিয়ে আসুন। আমি একটি বিমান পাঠাচ্ছি। ওদের দিল্লিতে আনার জন্য। শোকসন্তপ্ত ইন্ধিরা গান্ধী তখন ধাওয়ানকে বললেন, মানু কোথায়? অর্থাৎ সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় তখন দিল্লিতে নেই। তিনি তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, তারপর তিনি ধাওয়ানকে বললেন, বেবী কোথায়? বেবী ছিলেন তার মন্ত্রিসভার একজন সিনিয়র মন্ত্রী। তিনিও তখন দিল্লিতে নেই। ধাওয়ানকে ধমক দিয়ে বললেন কে আছেন, তাকে ডাকো। ধাওয়ান বললেন জুনিয়র মন্ত্রী প্রণব আছেন অর্থাৎ প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনি বললেন, প্রণবকে ডাকো, প্রণব বাবুকে নির্দেশ দিলেন তুমি এখনই আমার  এয়ারফোর্সের বিমান নিয়ে জার্মানিতে চলে যাও। আর ধাওয়ানকে নির্দেশ দিলেন তুমি দিল্লিতে একটা বড় বাড়ি দেখে রাখ এবং ওদের যাবতীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা কর। তার নির্দেশ মতো কাজ হলো। প্রণব বাবু এয়ারফোর্সের বিমান নিয়ে জার্মানির তৎকালীন রাজধানী বন-এ চলে গেলেন। তাদের নিরাপদে দিল্লিতে নিয়ে আসা হলো। তিনি বিদেশ সচিবকে বললেন, ঢাকার হাইকমিশনার কোথায়? হাইকমিশনার সেদিন কলকাতায় ছিলেন। সব যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন তাই তিনি ঢাকা যেতে পারছেন না। ৩ দিন পর হাইকমিশনার সমর সেন সড়ক পথে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করলেন। আমরা কলকাতার কয়েকজন সাংবাদিক সীমান্ত পেট্রাপোলে গেলাম। সমর সেন NO MAN-LAND- অতিক্রম করে হেঁটে ওপারে চলে গেলেন, সন্ধ্যায় তিনি ঢাকায় রাষ্ট্রপতি ভবনে গেলেন। সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিল খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং জিয়াউর রহমান। খোন্দকার সমর বাবুকে বললেন, আমরা চাই ভারত সরকার এই নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দিক। সমর সেন উত্তরে বললেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে আপনারা ’৭২ সালে ঢাকায় এবং ’৭৪ সালে দিল্লিতে ইন্ধিরা-মুজিব যে চুক্তি হয়েছিল তা বাতিল করে দিয়েছেন। সমর সেন খন্দকারের মুখের ওপর বলেছিলেন, এটি বেআইনি সরকার, আমরা এই সরকারের স্বীকৃতি দেব না। আলোচনায় জিয়াও অংশ নিয়েছিল। ঝানু কূটনীতিক সমর সেন খন্দকারকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন ওই চুক্তিগুলো পুনর্বহাল করা না পর্যন্ত ভারত আপনাদের কিছুই মেনে নেবে না। এর পরেই খন্দকার, জিয়া ও আরও কয়েকজন সামরিক অফিসার অন্য একটি ঘরে গিয়ে আলোচনা করলেন, ফিরে এসে খন্দকার বললেন, আমরা চুক্তি পুনর্বহাল করব, আপনারা আমাদের স্বীকৃতি দিন। সমর সেন জবাবে বললেন, আগে আপনারা লিখিত চিঠি দিন। আপনাদের চিঠি আমি দিল্লিতে পাঠাব। তারপর স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিল্লি নেবে। চিঠিটি সমর সেন দিল্লিতে পাঠিয়ে দিলেন এবং ঢাকার বেতারে খন্দকারের ওই চিঠির কথা ঘোষণা করা হলো। তিন দিন পর দিল্লি থেকে ভারত সরকার খন্দকার-জিয়া সরকারকে স্বীকৃতির কথা জানিয়ে দিল।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়া-খন্দকার সরকার আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত হিন্দু-মুসলমানকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। জিয়ার সামরিক সরকারের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ১৯৭৫-৭৬ সালে আবার হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমান ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গে এসে আশ্রয় নেয়। অত্যাচারিত জিয়ার দাপট এত বেড়ে যায় যে, ১৯৭১ সালের মতো আশ্রয়ের সন্ধানে বাঙালিরা পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। জিয়া তাদের ফেলে আসা সম্পত্তি সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিলি করে দেয়, আমাদের কাছে বহু খবর আসতে থাকে কিন্তু আমরা তা ছাপতে পারিনি। তার কারণ হলো ভারতে তখন ছিল জরুরি অবস্থা এবং সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরশিপ। আমরা যখন আমাদের কপি নিয়ে রাইটার্সে যেতাম তখন করণিকরা যারা ভালো বাংলা বোঝেন না এবং বাংলাদেশ বাঙালি এসবও বোঝেন না তারা আমাদের লেখা কেটে দিতেন। তখন কিছুদিন আমরা লেখা বন্ধ রাখলাম। হঠাৎ সম্পাদক অশোক সরকার আমাদের ডেকে বললেন, বাংলাদেশে এত কিছু ঘটছে আপনারা লিখছেন না কেন? আমরা বললাম খবরের কাগজের ওপর সেন্সর চালু হয়েছে। তাই লিখছি না। তিনি আমাদের বললেন, আপনারা সেন্সরে যাবেন না। যা ঘটছে তাই লিখুন। সেন্সর ছাড়া অনেক ঘটনা আমরা লিখলাম। হঠাৎ একদিন রাইটার্স থেকে একটি চিঠি এলো সম্পাদকের কাছে। তাতে লেখা সেন্সর চলাকালীন আপনারা বাংলাদেশের ঘটনা ছাপছেন। কেন আপনাদের প্রেস বন্ধ করে দেওয়া হবে না? চিঠিটি পকেটে করে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের তথ্য সচিব আর চক্রবর্তীর ঘরে গেলাম। তাঁকে চিঠিটি দেখাতেই তিনি বললেন-ও এই ব্যাপার। আমাকে চিঠিটি দিন। এই বলে নিজের ঘরে একটি আলমারিতে চিঠিটি রেখে দিয়ে বললেন যান, লিখুন গিয়ে। তিনি আমাদের ভরসা দিলেন। আমরাও নিয়মিত লিখলাম, যারা বাংলাদেশ থেকে অত্যাচারিত হয়ে আসছে তাঁদের নিয়ে প্রচুর লিখলাম। আমার আরও মনে আছে সদ্য প্রয়াত বাংলাদেশের আর একজন মিলিটারি অফিসার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যিনি ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে থেকে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার পর পাকিস্তান থেকে এসে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। ঢাকায় তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার দিন তিনি ছিলেন হায়দরাবাদে। ভারতীয় সৈন্যদের কাছে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর পেয়ে তিনিও ঢাকা যাচ্ছিলেন। জিয়া থেকে এরশাদ সবাই ছিলেন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মেজর। ক্ষমতা দখল করে এরা সব জেনারেল হয়ে গিয়েছিলেন। নিজেরাই নিজেদের প্রমোশন দিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যার চার মাস পর নভেম্বর মাসে ঢাকার সেন্ট্রাল জেলে বন্দী অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয়-  সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবু হেনা কামারুজ্জামান ও অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে। যা হিটলারও করেনি। তা করে দেখাল আরেক মেজর ডালিম। ওই চার নেতাকে হত্যা করে বাংলাদেশ রেডিওতে ঘোষণা করলেন- আর জয় বাংলা সেøাগান হবে না, হবে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। এই বলে তিনি আমেরিকার পথে ব্যাংককে রওনা হলেন। ডালিমকে আমি চিনতাম কারণ কলকাতায় অবস্থানকালে পাকিস্তান হাইকমিশনের অফিসে প্রথম সচিব আইএসআইয়ের কাভার পোস্টিংয়ে ছিলেন। ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে জাহানারা ইমামের বাড়িতে ডালিম সাহেবের সঙ্গে আমার একবার দেখা হয়েছিল সম্ভবত ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে। তখনই তিনি তার আর কয়েকজন বন্ধুকে বোঝাচ্ছিলেন পাকিস্তান ভেঙে বঙ্গবন্ধু খুব অন্যায় করেছেন।

আবার ফিরে এসেছে সেই অভিশপ্ত আগস্ট মাস। তাই স্বভাবতই বাঙালিদের মনে সেই শোকের ছাপটা রয়ে গেছে।  যতদিন চাঁদ-সূর্য উঠবে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভূমিকা বাঙালিরা মনে রাখবে।

সর্বশেষ খবর