আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের শুরুতে দেওয়া দার্শনিক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির একটি উক্তি সর্বজন পঠিত। তা হলো- লক্ষ্য মাধ্যমের যৌক্তিকতা বিধান করে, মাধ্যম লক্ষ্যের নয় (End justifies the means, not means the end)। রাষ্ট্র হচ্ছে বাস্তব প্রতিষ্ঠান এবং এর ক্ষমতাই সর্বোচ্চ। তিনি মনে করতেন- ধর্ম ও নৈতিকতার মাধ্যমে রাষ্ট্র যদি তার লক্ষ্য অর্জন করতে পারে, তা হবে সর্বাপেক্ষা উত্তম। কিন্তু মানুষ প্রকৃতিগতভাবে দুর্নীতিপরায়ণ, প্রতারক, লোভী ও হিংসুটে হওয়ায় এ পথে কখনোই রাষ্ট্র তার লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না। সেজন্য শাসকের কার্যসিদ্ধি করতে যদি ধর্মকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়, সেটা অনুচিত হবে না। শাসক তার লক্ষ্য অর্জনের প্রয়োজনে আন্তরিকতা, সততা, মানবতা ও ধার্মিকতার ভান করবে (ম্যাকিয়াভেলির এ উপদেশকে অনেকে অনৈতিক হিসেবে পরিত্যাগ করলেও স্বৈরাচারী শাসকরা যুগে যুগে এ নীতি ব্যবহার করে তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার বহু নজির রয়েছে)। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে পারলৌকিকতা যদি একমাত্র লক্ষ্য হয়, তাহলে ইহলৌকিকতা গৌণ হয়ে যেতে পারে। আর যদি ইহলৌকিকতা লক্ষ্য হয়, তখন মাধ্যম হিসেবে ধর্মীয় আদেশ-উপদেশও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। এখানে একটি ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে একটি ধারার কিছু অংশ উল্লেখ করা যায়- ‘সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত অপর কাহাকেও বাদশা, রাজাধিরাজ ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মানিয়া লইবে না, কাহাকেও নিরঙ্কুশভাবে আদেশ ও নিষেধ করিবার অধিকারী মনে করিবে না, কাহাকেও স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধানদাতা ও আইনপ্রণেতা মানিয়া লইবে না।’ নির্বাচন কমিশনের কাছে সংবিধানের সঙ্গে এ ধারা সাংঘর্ষিক হওয়ায় এ ধারা পরিবর্তন করে দলটি নিবন্ধন পাওয়ার আবেদন করে। সবার জানা রয়েছে, এক সময় গির্জার অধীনে রাষ্ট্র ছিল। রাজা যাজকদের পরামর্শে রাজ্য চালাতেন। সে সময় যুক্তি ছিল, পার্থিব সুখের চেয়ে বড় জিনিস আত্মার মুক্তি। সেজন্য সে সময় পারলৌকিকতাকে লক্ষ্য করেই শাসনকার্য পরিচালিত হতো। মধ্যযুগের শেষের দিকে পোপ ও সম্রাটের বিরোধ চরমে উঠলে দার্শনিকরা দুই তরবারির তত্ত্ব দেন। তা হলো পার্থিব জীবনে সম্রাট এবং আধ্যাত্মিক জীবনে পোপ। কিন্তু যখন দার্শনিকরা প্রমাণ পেলেন, পার্থিব জগতের সমৃদ্ধি অর্জনে অপার্থিব জগতের যুক্তি সব সময় কাজে আসে না, তখন ধর্মকে রাজনীতি থেকে চিরতরে বাদ দেন। আধুনিক যুগের রাজনীতিতে লক্ষ্য অর্জনে মাধ্যম পরিবর্তনের আরও উদাহরণ রয়েছে; যেমন-চীনের বর্তমান রাজনীতিতে একটি কথা আছে-বিড়ালটি সাদা কি কালো বড় কথা নয়, আসলে বিড়ালটি ইঁদুর ধরতে পারে কি না! অর্থাৎ দেশের সমৃদ্ধি অর্জনে নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির চেয়ে বাজার অর্থনীতি অধিক কার্যকরী হলে সেটা গ্রহণ করাই যুক্তিযুক্ত হবে। তৃতীয় বিশ্বের প্রায় দেশের রাজনীতি ব্যক্তি ও পরিবারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়ায় গণতন্ত্র, মানবতা, আইনের শাসন ইত্যাদি লক্ষ্য না হয়ে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেরেমি বেনথামের (Jeremy bentham) উপযোগ তত্ত্ব প্রাসঙ্গিক হতে পারে। তিনি রাষ্ট্র, সরকার, নৈতিকতা, আইন প্রণয়ন প্রভৃতি ব্যাপারে উপযোগিতার নীতিকেই একমাত্র সূচক হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তিনি মনে করেন-ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি নয়- এটিই হচ্ছে ব্রিটিশ রাষ্ট্রতত্ত্বের মূল ভিত্তি। প্রকৃতি মানব জাতিকে আনন্দ ও বেদনার দুই সার্বভৌম প্রভুর শাসনাধীনে স্থাপন করেছে। সেহেতু সরকারের পক্ষে ব্যক্তি পর্যায়ে প্রত্যেকের বাসনার অনুকূলে কাজ করা সম্ভব নয়। অতএব জনসংখ্যার সর্বাধিক অংশের যেটি বাসনা সেটি হচ্ছে যথার্থ বাসনা এবং এ বাসনাকে সর্বাধিক মাত্রায় চরিতার্থ করাই হচ্ছে সরকারের সঠিক লক্ষ্য। ব্রিটিশ শাসনের বিবর্তনের দিকে তাকালে তার মতামতের যথার্থতা পাওয়া যায়। ১০৬৬ সালে নর্মান বিজয়ের পর ইংল্যান্ডে রাজার ক্ষমতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাজা উইলিয়াম এবং তাঁর উত্তরাধিকারীরা গির্জা, শায়র ও কাউন্টিগুলোর ওপর সর্বময় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে শাসনতন্ত্রের ক্রমবিকাশে যেসব ঘটনা ঘটতে থাকে, তাতে রাজার ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। ১২১৫ সালের মহাসনদ, ১২৯৫ সালের আদর্শ পার্লামেন্ট, ১৬২৮ সালের অধিকারের আবেদনপত্র, ১৬৮৯ সালের অধিকারের বিল, ১৭৪২ সালে ক্যাবিনেট প্রথার মূলনীতি প্রবর্তন ইত্যাদিতে জনগণের সার্বভৌমত্বই জয়ী হতে থাকে। বর্তমানে ইংল্যান্ডের রাজা রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রধান ও ঐক্যের প্রতীক মাত্র। এ দেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের পক্ষে-বিপক্ষে বহু মতামত রয়েছে। কিন্তু স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, কোনো আন্দোলনই ব্যক্তি বা পরিবারকে লক্ষ্য করে সংঘটিত হয়নি।
তারা ক্ষমতায় গিয়ে বগলে ইট রেখে মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে। তারা ব্যক্তিতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র ও দলীয়তন্ত্রকে মাধ্যম করতে গিয়ে গণতান্ত্রিক মতবাদকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে। তারা ভুলে যান যে- কথা বলার স্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা ও চলাফেরার স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। ইউরোপের কল্যাণকর দেশগুলোও শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত নয়। তবে তাদের চেষ্টা থাকে দুর্নীতি হ্রাস করার। চেষ্টা থাকে জনগণের আরও কল্যাণ করার। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের শাসকদের গণতন্ত্রে পৌঁছানোর লক্ষ্যে সেরকম চেষ্টা থাকে না বলেই বহু রকম সমস্যার সৃষ্টি হয়।
লেখক : গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক