আম্মাজান হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র হুবহু ‘কোরআনুল কারিম’ অর্থাৎ যেমনটি কোরআনুল কারিম একটি কিতাব, তদ্রূপ প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন একটি বাস্তব জীবন্ত কিতাব। কেননা তিনি আল্লাহপাকের নাজিলকৃত সব বিধানের সমন্বয়ে বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। সব আদেশ ও নিষেধগুলোকে সর্বাধিক সন্তুষ্টির সঙ্গে মনেপ্রাণে অন্তঃকরণে ভালোবেসে তা গ্রহণ করেছিলেন। তাই পবিত্র মহাগ্রন্থ আল কোরআন এবং রহমাতুল্লিল আলামিনের জীবন চরিত্র এক ও অভিন্ন ছিল। তাই তো আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করলেন, যে রসুলকে অনুসরণ করল সে মূলত আল্লাহকেই অনুসরণ করল। অতঃপর আল্লাহতায়ালা তাঁর পিয়ারে হাবিবকে কোরআনের মডেল ও অনুকরণীয় করে গোটা বিশ্ববাসীর মুক্তি ও নাজাতের জন্য শিক্ষক হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। ‘মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’ এ বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো, তাঁরই আনুগত্য, ইতাআত, অনুসরণ ও অনুকরণ করা। সঙ্গে সঙ্গে এ বিশ্বাসও করা যে, একমাত্র তাঁর আনুগত্য ও অনুকরণের মাধ্যমেই কেবল আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি, মুক্তি ও হেদায়েত পাওয়া সম্ভব। এর ভিন্ন কোনো পথ অবলম্বনকারীকে পথভ্রষ্ট বলে বিবেচিত করা হবে। এমনকি সব রকমের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে সব মানুষের, সব মতের ঊর্ধ্বে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা, আদেশ-নিষেধ ও আদর্শকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করাই হলো ইসলাম। আর এটিই হলো আল্লাহপাকের অভিপ্রায়। তাই তো আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করলেন, আল্লাহ এবং তাঁর রসুলের হুকুম মান্য করো, যদি ইমানদার হয়ে থাকো। (সুরা আনফাল, আয়াত-১)। একজন মুমিন পূর্ণাঙ্গভাবে আল্লাহর রসুলকে অনুসরণ করার মাধ্যমে মূলত আল্লাহকেই সে অনুসরণ করল। আল্লাহতায়ালা বলেন, যে ব্যক্তি রসুলের হুকুম মান্য করল সে আল্লাহরই হুকুম মান্য করল, আর যে লোক বিমুখতা অবলম্বন করল আমি আপনাকে তাদের জন্য রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত করে পাঠাইনি। (সুরা নিসা, আয়াত-৮০)। এর পাশাপাশি প্রতিটি মুমিনকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনীয় সব বিধিবিধান ও নেতৃবৃন্দের বৈধ বিষয়ে আনুগত্য করাও জরুরি। তবে এসব ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো যে আল্লাহ ও আল্লাহর রসুল তথা কোরআন ও হাদিসবিরোধী, ইসলামবিরোধী কোনো বিষয় নির্ধারণ হলে, যা একজন মুমিনের পক্ষে ইমান, আমল ও আখেরাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, তবে সে ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের নির্দেশনার দিকেই ফিরে যেতে হবে এবং সেখান থেকেই তার সুষ্ঠু সমাধান খুঁজে নিতে হবে ও কোরআন সুন্নাহর আলোকে তার নিষ্পত্তি করতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, হে ইমানদারগণ! আনুগত্য করো আল্লাহর ও আনুগত্য করো রসুলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা আদেশের মালিক তাদের, তারপর যদি তোমরা কোনো বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়ো তাহলে তা আল্লাহ তাঁর রসুলের প্রতি প্রত্যর্পণ করো, যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিবসের ওপর বিশ্বাসী হয়ে থাকো। (সুরা নিসা, আয়াত-৫৯)। কর্মে ও বর্জনে তাঁর সুন্নত বা জীবনাদর্শই প্রতিটি মুসলিমের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ এবং এতেই রয়েছে দুনিয়াবি শান্তি ও পরকালীন মুক্তি এবং নাজাত। মহান রব্বুল আলামিন বলেন, নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রসুলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে, যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য। (সুরা আহজাব, আয়াত-২১)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, হে নবী আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, তবে আল্লাহ ও তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেবেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাশীল-দয়ালু। বলুন আল্লাহ ও রসুলের আনুগত্য প্রকাশ করো, বস্তুত যদি তারা বিমুখতা অবলম্বন করে, তাহলে আল্লাহ কাফেরদিগকে ভালোবাসেন না। (সুরা আলে ইমরান, ৩১-৩২ আয়াত)। মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আমার সুন্নতকে অনুসরণ করে, তারাই মূলত আমাকে ভালোবাসে। আর যে আমাকে ভালোবাসবে সে অবশ্যই আমার সঙ্গে জান্নাতে প্রতিবেশী হবে, আল হাদিস। সুতরাং নবীর প্রতিটি সুন্নতকে মনেপ্রাণে ভালোবেসে অনুসরণ না করে শুধু মুখে মুখে নবীকে ভালোবাসা, নবীজির কষ্টের কথা স্মরণ করে চোখের অশ্রু বিসর্জন করা, জশনে জুলুস পালন করে আশেকে রসুল দাবি করার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। নবীজি ইরশাদ করেন- আমার প্রতিটি খাঁটি উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে, তবে যারা আমাকে অস্বীকার করে, তারা ব্যতীত। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন- ইয়া রসুলুল্লাহ! কারা আপনাকে অস্বীকার করে? নবীজি বললেন, যারা আমাকে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করে তারা আমার খাঁটি উম্মত এবং জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যারা আমার অনুসরণ করে না, তারাই মূলত আমাকে অস্বীকার করে। আল হাদিস। নবীজি আরও ইরশাদ করেন- প্রতিটি মানুষ যে পথ, মত, বিশ্বাস, কৃষ্টি কালচার, ধর্মকর্ম ও ব্যক্তিকে ভালোবাসবে, কেয়ামতের ভয়াবহ কঠিন হিসাবনিকাশের দিনে সে তারই সঙ্গী হয়ে উঠবে। আল্লাহপাক আমাদের হেফাজত করুন। আমিন।
লেখক : ইমাম ও খতিব, কাওলারবাজার জামে মসজিদ, দক্ষিণখান, ঢাকা