বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

কেমন আছেন হিন্দু শরণার্থীরা

দুই পাড়ায় ৮৬ জনকে হত্যা, বিধবা হলেন ৮ তরুণী, বহু নারী ধর্ষিত

মাহমুদ আজহার ও ফারুক তাহের, কুতুপালং ও বালুখালী (কক্সবাজার) থেকে

কেমন আছেন হিন্দু শরণার্থীরা

উখিয়ার কুতুপালংয়ে গতকাল হিন্দু শরণার্থীরা —রোহেত রাজীব

মিয়ানমারের ফকিরাবাজার এলাকায় স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই ছিলেন রিকা ধর (৩০)। সেখানে অবস্থাপন্ন স্বামীর ছিল জুয়েলারি দোকান। কিন্তু ২৫ আগস্ট দুপুরে মুহূর্তেই সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। একদল কালো মুখোশ ও জামা পরা লোক ধারালো ছুরি ও তলোয়ার দিয়ে ফকিরাবাজারের জুয়েলারি দোকানে হামলা চালিয়ে তার স্বামী প্রবল ধরসহ চারজনকে কুপিয়ে হত্যা করে। সেই সঙ্গে হত্যা করে তার দুই ভাই ও দোকানের এক কর্মচারীকে। পরপর জন্ম নেওয়া তিন শিশুকে নিয়ে পালিয়ে আসার সময়ও রিকা ধরকে মারধর করা হয়। সেই সঙ্গে ছিনিয়ে নেওয়া হয় তার কানে ও গলায় পরা অলঙ্কারগুলো। শুধু রিকা ধরই নন, ফকিরাবাজারে ৭০টি হিন্দু পরিবারের ৮৩ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ ছাড়াও চিকনছড়া থেকে বেড়াতে যাওয়া তিনজনকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই এলাকায় হিন্দু পরিবারের মোট ৮৬ জন পুরুষকে মেরে ফেলা হয়। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় সব বাড়িঘর। বাজারে প্রবল ধরের জুয়েলারি দোকান থেকে লুট করা হয় প্রায় ৫০ ভরি স্বর্ণ। রিকা ধরের পরনে যা স্বর্ণালঙ্কার ছিল তাও কেড়ে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। ফেলে যায় প্রবল ধরের ক্ষতবিক্ষত লাশ। শুধু প্রবল ধর নয়, তলোয়ার দিয়ে কেটে কেটে হত্যা করা হয় বলিবাজার, সাহেব বাজার, নাকপুরার সরস্বতী ধর, রসবালা রুদ্র, প্রমীলা শীল, অনিকা ধর, বীনা শীলসহ অসংখ্য হিন্দু নারীর স্বামী ও তাদের শ্বশুর-ভাশুর এবং দেবরকে। মুখোশ পরা দুর্বুত্তরা তখন অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিয়ে মহিলাদের ধমক দিয়ে বলতে থাকে— ‘তোরা ইন্ডিয়ার হিন্দু ইন্ডিয়াতে চলে যা। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে না গেলে সবাইকে মেরে ফেলব।’ তাই উপায়ান্তর না দেখে এক কাপড়ে সন্তান-পরিজন নিয়ে ওই দিনই প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে রোহিঙ্গাদের সঙ্গেই হাঁটা শুরু করে হিন্দু পরিবারগুলো। গতকাল দুপুরে সরেজমিন গিয়ে দেখা হয় হিন্দু পরিবারগুলোর সঙ্গে। উখিয়ার হলুদিয়া ইউপি সদস্য স্বপন শর্মা রণির বাড়িতে একটি পরিত্যক্ত মুরগির ফার্মে আশ্রয় নিয়েছেন ৫১৮ জনের এই দলটি। এখানে তারা অন্যান্য রোহিঙ্গা শরণার্থীর চেয়ে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছেন। প্রতিদিন দুই বেলা ৫১৮ জনের জন্য রান্না হয় এখানে। বিভিন্ন সংস্থার দেওয়া ত্রাণসামগ্রী থেকে সবার জন্য রান্না হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন শাখা সংগঠনের পক্ষ থেকে তাদের নিয়মিত খোঁজ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান আশ্রয় নেওয়া বিনেশ্বর শীল। ওই আশ্রয় কেন্দ্রেই কথা হয় ৮ বিধবা মহিলার সঙ্গে। যাদের প্রত্যেকের স্বামীকে মিয়ানমারে গত ২৫ আগস্ট হত্যা করা হয়। যাদের প্রত্যেকের বয়স হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা বিধাব অনিকা ধরের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে অঝরধারায় চোখের পানি পড়তে থাকে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘দেড় বছর আগে ফকিরাবাজারের মেলিঙ্গা ধরের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। আমার সামনেই আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়। আমার ভাবতেই ভীষণ কষ্ট হয়— গর্বে থাকা শিশুটি জন্ম নিলে সে তার পিতাকে দেখতে পাবে না কোনোদিনই।’ এভাবে স্বামীহারা ৮ নারীর মধ্যে সরস্বতী ধর, রসবালা রুদ্র, প্রমীলা শীল, বীনা শীল জানালেন তাদের সামনে নির্মমভাবে নিহত হওয়া স্বামী-স্বজনদের কথা, তাদের কষ্টের কথা। তবে হিন্দু-মুসলিম বেশ কয়েকজন নারী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা বহু নারীই মিয়ানমারে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

সর্বশেষ খবর