কভিড-১৯ মহামারির পর সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এতটা অস্থিরতা আর কখনো দেখা যায়নি। গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ৯ মাস পর এখন সামাজিক ক্ষেত্রেও তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে প্রতিনিয়ত। আস্থার সংকটে নতুন করে কোনো বিনিয়োগ আসছে না। এমন সময়ে দেশীয় উৎপাদন এবং রিজার্ভ বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে দারিদ্র্য ও বেকারের সংখ্যা। শুধু তাই নয়, গত ৯ মাসেই নতুন করে ২৭ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে অনেক কলকারখানা, দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। এজন্য আসছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাজেটের আকার ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির টার্গেট কমিয়ে ধরা হচ্ছে। সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে। এ ছাড়া কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগকে বৃদ্ধির সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা খাতকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে আগামী বাজেটে।
দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, আর্থিক সংকট এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ক্রমবর্ধমান চাপের কারণে ব্যবসায়ী নেতাদের মাঝে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সারা দেশের শিল্প খাত ব্যাপক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যার ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাজেট বাস্তবায়নের ওপর। কেননা ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে না পারলে কর দেবেন কোথা থেকে- এমন প্রশ্ন রেখেছেন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান। তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছেন। একদিকে ভ্যাট-ট্যাক্সের চাপ, অন্যদিকে মামলা-মোকদ্দমার আতঙ্ক। গ্যাস-বিদ্যুতের পুরোনো সংকট তো আছেই। আবার কর্র্মীদের বেতন-ভাতা দিয়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জে আমরা দিশাহারা হয়ে পড়েছি। সূত্র জানায়, এনবিআরকে বিলুপ্ত ঘোষণার প্রতিবাদে কর্মীদের আন্দোলনে অচল হয়ে পড়েছে রাজস্ব খাত। এদিকে অর্থবছর (২০২৪-২৫) শেষে রাজস্ব ঘাটতি ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা করা হচ্ছে। এ ছাড়া সরকারি চাকরিবিধির জারি করা নতুন অধ্যাদেশকে ঘিরে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে এটা দীর্ঘায়িত হলে আরও চাপে পড়বে অন্তর্বর্তী সরকার। এমন এক ঘোলাটে পরিস্থিতির মধ্যে নতুন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। অবশ্য ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যে এবার বাজেটের আকার কমিয়ে ধরা হচ্ছে। যা ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার মধ্যেই থাকবে বলে জানিয়েছেন ড. সালেহউদ্দিন। যেখানে চলতি বছরের বাজেটের আকারই ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার। এত সব অস্থিরতা আর হাজারো সমস্যার মধ্যে থাকা জনগণকে আগামী ২ জুন কতটা স্বস্তি দিতে পারবেন অর্থউপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এটা এখন বিরাট প্রশ্ন। অবশ্য এমন প্রশ্নের উত্তর ড. সালেহউদ্দিন খুব সহজভাবেই দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, একটি সত্যিকার অর্থে সমতা ও জনকল্যাণকর বাজেট আমরা দেব। যার উপকারভোগী হবেন দেশের ১৮ কোটি মানুষ।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে যতটুকু অর্থায়ন করতে পারবেন ঠিক ততটুকু বাজেট দেওয়া। আমি অর্থউপদেষ্টাকে বলব আপনি যেটা অর্থায়ন করতে পারবেন না, সেটা বলবেন না। সেই বাজেট আপনি করবেন কেন? যে বাজেট আপনি অর্থায়ন করতে পারবেন না। এদিকে অর্থনীতির সবচেয়ে অস্বস্তিকর সূচক মূল্যস্ফীতির চাপ ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার টার্গেট করছে সরকার। যদি বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা সম্ভব নয়। এ ছাড়া নির্বাচনি ডামাডোল ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং এনবিআরকে বিলুপ্ত করার প্রতিবাদে চলমান আন্দোলনে রাজস্ব আদায়ে ভাটা পড়েছে। ফলে নতুন বছরে রাজস্ব খাতটা আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে।
অর্থ বিভাগের একটি সূত্র জানায়, এমনিতেই নির্বাচনি চাপ নিয়ে সরকারের ভিতরে-বাইরে রয়েছে অস্থিরতা। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে নির্বাচনি চাপ। আসছে বাজেটে জাতীয় নির্বাচনের জন্য পৃথকভাবে তহবিল বরাদ্দও রাখা হচ্ছে। আবার সরকারি কর্মচারীদের জন্য ঘোষিত মহার্ঘ ভাতা ১ জুলাই থেকে বাস্তবায়ন করতে হলে অতিরিক্ত আরও ৭ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। যা বাজেটে একটা বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। প্রবাসীরা বেশি করে রেমিট্যান্স পাঠানোয় রিজার্ভ বাড়ছে। রপ্তানি খাতেও কিছুটা প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে বেকার এবং দারিদ্র্যের হার বাড়ায় আবারও ভারসাম্যহীন হয়ে পড়তে পারে সামষ্টিক অর্থনীতি বলে মনে করেন বরেণ্য অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য। খোদ অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, গত পাঁচ বছরে এতটা অস্থির আর সংকট নিয়ে বাজেট প্রণয়ন করতে হয়নি। একে তো বিশেষ ধরনের সরকার। আবার এই সরকারের ভিতরে ও বাইরে নানানরকমের অস্থিরতাও রয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ ছাড়া বহির্বিশ্বের সঙ্গেও নানানরকমের তিক্ততা তৈরি হয়েছে। ফলে এবারের বাজেটটা কঠিন এক চ্যালেঞ্জিং সময়ে ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থউপদেষ্টা।