১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোরে চট্টগ্রামে বিপথগামী কিছু সেনা কর্মকর্তার অভ্যুত্থানে নিহত হন রাষ্ট্রপতি, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। এ হত্যাকাণ্ড দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গভীর ছাপ ফেলে। হত্যা-পরবর্তী দিনগুলোতে ঘটে যায় একের পর এক নাটকীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা ভবিষ্যতের রাজনৈতিক গতিপথও নির্ধারণ করে দেয়...
রেডিওতে মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা
২৯ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্থানীয় দলে বিভক্তি নিরসনের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামে যান। রাতে বৈঠক শেষে বিশ্রামে গেলে ৩০ মে ভোরে সেনাবাহিনীর একটি দল তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। সকালে চট্টগ্রাম বেতারে সংবাদ শুরু হলেও তিন মিনিটের মাথায় তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর চট্টগ্রামের জিওসি মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরের বরাতে রাষ্ট্রপতি জিয়ার মৃত্যুর সংবাদ প্রচার করা হয়। সংবাদ প্রচারের আগ পর্যন্ত প্রশাসনসহ অধিকাংশ মানুষ তাঁর মৃত্যুর খবর জানতেন না।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা গ্রহণ
ঘটনার পর উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মন্ত্রিসভার সদস্য এবং বাহিনীপ্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে সবাই তাঁকে সমর্থন জানান। ৩০ মে বিকালে জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি সংবিধানের ৫৫ (১) ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের কথা জানান এবং শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় জনগণের সহায়তা কামনা করেন। একই সঙ্গে তিনি ৪০ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেন।
জরুরি অবস্থা জারি
ঘটনার পরদিনই দেশজুড়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। সভাসমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। তবে সংবিধান ও সংসদ কার্যকর থাকবে বলে জানানো হয়। একই দিন রাষ্ট্রপতি জিয়ার লাশ গোপনে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ি এলাকায় দাফন করা হয়। সেনাবাহিনীর মেজর শওকত আলীর নেতৃত্বে এ দাফন সম্পন্ন হয়।
চট্টগ্রামে যুদ্ধের পরিবেশ
সার্কিট হাউস থেকে ফিরে সেনা কর্মকর্তা মেজর রেজাউল করিম রেজা চট্টগ্রামে এক যুদ্ধাবস্থা দেখতে পান। অভ্যুত্থানকারী মেজর জেনারেল মঞ্জুর সেনা সদস্যদের উদ্দেশে বক্তব্য দিচ্ছিলেন এবং ঢাকায় সেনাপ্রধান এরশাদের সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। রেজার মতে মঞ্জুর হয়তো এরশাদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি চাননি।
সান্ধ্য আইনে বিচ্ছিন্ন চট্টগ্রাম
ঘটনার পর চট্টগ্রামে অভ্যুত্থানকারী সেনারা নিয়ন্ত্রণ নেন। জারি করা হয় সান্ধ্য আইন, পথে টহল দেন সেনারা। চট্টগ্রাম পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ঢাকার সঙ্গে। বন্ধ হয়ে যায় সড়ক, আকাশ এবং টেলিযোগাযোগ।
লাশ হস্তান্তরের আহ্বান
সরকার প্রেসিডেন্ট জিয়ার লাশ ঢাকায় আনার চেষ্টা করে। কিন্তু সরাসরি যোগাযোগ না হওয়ায় রেডক্রসের মাধ্যমে অনুরোধ জানানো হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজ জানান, চট্টগ্রামের সেনা কর্মকর্তা জেনারেল মঞ্জুর এ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন।
আত্মসমর্পণের নির্দেশ
৩১ মে সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এরশাদ অভ্যুত্থানকারী সেনাদের দুপুর ১২টার মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। আত্মসমর্পণ করলে সাধারণ ক্ষমা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে বলেও জানানো হয়।
বিপ্লবী পরিষদের দাবি
নিজেদের ‘বিপ্লবী পরিষদ’ পরিচয়ে জেনারেল মঞ্জুর চট্টগ্রাম বেতারে ভাষণ দেন। তিনি এরশাদকে বরখাস্ত করে মীর শওকত আলীকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করেন। মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বানও জানান। তবে ঢাকায় এরশাদের প্রতি আনুগত্যে কোনো পরিবর্তন না আসায় এ আহ্বানে সাড়া মেলেনি।
অভ্যুত্থানকারী দলে বিভক্তি
৩০ মে সংঘটিত অভ্যুত্থান ৩১ মে থেকে দুর্বল হতে থাকে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হান্নান শাহ জানান, অভ্যুত্থানকারী দলের ভিতর বিভক্তি দেখা দেয় এবং অনেকেই সরকারের পক্ষে চলে যান। এতে মঞ্জুর মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন।
মঞ্জুরের পলায়ন
৩১ মে রাতে মেজর জেনারেল মঞ্জুর, কর্নেল মতিউরসহ অনেকেই চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে পালিয়ে যান। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারের ভূমিকা ছিল সক্রিয়, যা কয়েক মাসের মধ্যেই নতুন শাসনব্যবস্থার পথ তৈরি করে দেয়।