ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে আরোপিত বাণিজ্য বিধিনিষেধের কারণে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির স্থানীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। ভারত সরকার কর্তৃক আরোপিত এই নিষেধাজ্ঞাগুলো ভারতেরই হাজার হাজার ব্যবসায়ী, শ্রমিক এবং সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের জীবনকে কঠিন করে তুলেছে। বিশেষ প্রতিবেদনে ভারতীয়দের সেই দুর্দশার চিত্রই তুলে ধরেছে হিন্দুস্তান টাইমস।
ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় অর্থনীতি:
ইন্দো-বাংলা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (গুয়াহাটি চ্যাপ্টার)-এর সাধারণ সম্পাদক অমরেশ রায় জানিয়েছেন, খাদ্য ও পানীয় সামগ্রী, প্লাস্টিক পণ্য এবং অন্যান্য কিছু আইটেম আমদানি-রপ্তানি সীমিত করা হয়েছে। যদিও তিনি মনে করেন এটি বাংলাদেশের জন্য বেশি ক্ষতিকর হবে, কারণ বাংলাদেশের বড় কোম্পানিগুলো ভারতীয় ক্রেতাদের উপর নির্ভরশীল। তবে, এর ফলে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে প্রায় ৩৫০০ সরাসরি এবং ১০,০০০-এর বেশি পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ট্রাক মালিক, চালক, মেরামতের দোকান, খাবারের স্টল এবং দৈনিক মজুরি শ্রমিকরাও এই বাণিজ্য বন্ধের কারণে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।
আসামের সুতারকান্দি স্থলবন্দর
আসামের শ্রীভূমি জেলার সুতারকান্দি স্থলবন্দর একটি প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র, যার অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে এই ব্যবসার উপর নির্ভরশীল। চন্দন দাস (৩৫), একজন পণ্য লোডার। তিনি জানান যে তিনি আগে দৈনিক ৫০০ থেকে ৭৫০ রুপি উপার্জন করতেন, কিন্তু এখন দিনে ৫০ থেকে ১৫০ টাকাও আয় করা কঠিন। তার পক্ষে সন্তানদের জন্য খাবার জোগাড় করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। স্থানীয় চায়ের দোকানদার সালমান আলী বলেছেন, গত বছর শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকেই পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করেছে এবং বর্তমান নিষেধাজ্ঞার ফলে জীবন আরও কঠিন হয়ে উঠছে।
মেঘালয়ের চিত্র
মেঘালয়ে, সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধের কারণে ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা এবং হাজার হাজার মানুষের জীবিকা ব্যাহত হয়েছে। রাজ্যের বাণিজ্য ও শিল্প বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে, মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যে মেঘালয় প্রায় ২.৫৪ কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে। ডাউকি, রাজ্যের অন্যতম ব্যস্ত স্থল শুল্ক স্টেশন থেকে কয়লা, বোল্ডার পাথর এবং চুনাপাথর রপ্তানিও বন্ধ হয়ে গেছে। শিলংয়ের একজন সিনিয়র বাণিজ্য কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রপ্তানিকারক, দৈনিক মজুরি শ্রমিক, ট্রাক চালক এবং ছোট ব্যবসায়ীরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সীমান্ত হাটগুলি, যা একসময় জীবনরেখা হিসেবে কাজ করত, সেগুলোও নিরাপত্তা বাড়ানো এবং চাহিদা কমে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে।
ত্রিপুরার পরিস্থিতি
ত্রিপুরার ব্যবসায়ীরা অবশ্য ততটা ক্ষতিগ্রস্ত হননি, কারণ ভোজ্য তেল, মাছ, এলপিজি এবং ভাঙা পাথরসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক পণ্য নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত রাখা হয়েছে। ত্রিপুরার শিল্প ও বাণিজ্য বিভাগের পরিচালক শৈলেশ কুমার যাদব সম্প্রতি এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে ব্যবসায়ীদের প্রতি আমদানি নিষেধাজ্ঞার নির্দেশনা মেনে চলার আহ্বান জানান। স্থানীয় দোকানদার বিধান সাহা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের পণ্য, যেমন প্যাকেটজাত মুড়ি, টোস্ট বিস্কিট এবং অন্যান্য এফএমসিজি সামগ্রীর কোনো ঘাটতি নেই। তবে, গ্রাহকদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি ভারত-বিরোধী মনোভাবের কারণে বাংলাদেশি পণ্য কেনার প্রতি অনীহা দেখা যাচ্ছে।
ত্রিপুরার আখাউড়া ইন্টিগ্রেটেড চেক পোস্টের মাধ্যমে গত বছর ৪৫৩ কোটি রুপির পণ্য আমদানি করা হয়েছিল। ত্রিপুরা মূলত পাথর, ডাল, শুকনো লঙ্কা, আদা, জিরা ইত্যাদি রপ্তানি করে, এবং বিভিন্ন ধরণের মাছ, এলপিজি, সিমেন্ট, পিভিসি দরজা, কাঠের আসবাবপত্র, প্লাস্টিক সামগ্রী, তুলার বর্জ্য ইত্যাদি আমদানি করে। তবে, ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০০৮.৪০ কোটি রুপি থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭১৫.৯৮ কোটি রুপিতে নেমে এসেছে।
মিজোরামের অবস্থা:
পশ্চিম মিজোরামের ঐতিহ্যবাহী সীমান্ত বাণিজ্য বিধিনিষেধের কারণে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে, যা এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে, বিশেষ করে আদা রপ্তানিতে, নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আইজল-ভিত্তিক স্টারফিনের সিইও মালসাওমি বলেছেন যে বাংলাদেশে রপ্তানি স্থগিতের ফলে মিজোরামের আদা ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। তিনি জানান, আদা এখন মিজোরামে প্রতি কেজি ১৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যেখানে দিল্লি, শিলচর এবং শিলিগুড়িতে এর দাম ২৮ টাকা।
সীমান্তবর্তী শহর তলাবুং-এর স্থানীয় ব্যবসায়ী হ্রিয়াতপুইয়া বলেছেন যে সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী (বিএসএফ) এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) উভয়ই সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ কঠোর করেছে, যার ফলে গ্রামগুলির মধ্যে ঐতিহ্যবাহী আদান-প্রদান কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল