জুলাই বিপ্লবের ভিত্তিতে আগামী বাংলাদেশ পরিচালিত হওয়ার জন্যই জুলাই সনদ প্রণীত হয়েছে। জাতীয় জুলাই সনদ কোনো কাগুজে সনদ নয়। এ সনদকে সরকারি আদেশের মাধ্যমে প্রাথমিক আইনি ভিত্তি দিতে হবে। এরপর আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদকে চূড়ান্ত আইনি ভিত্তি দিয়ে নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। তা না হলে জাতীয় নির্বাচনে জটিলতা তৈরি হবে। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের দিনে গণভোট হলে তাতে ৫% ভোটও পড়বে না। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। এ সাক্ষাৎকারে ১৯৯৬-এর নির্বাচনে বিএনপির পরাজয়ের কারণ, আগামী নির্বাচন, দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, দলের বাইরে প্রার্থী দেওয়া, আলাদা গণভোট চাওয়ার কারণসহ সমমনা দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনি সমঝোতার কৌশল, ভারতবিরোধিতার কারণ এবং জামায়াতের রাজনীতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন তিনি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ৫৪ বছরে এসে বর্তমানে বেশ স্বস্তিকর অবস্থায় রয়েছে জামায়াতে ইসলামী, যা অতীতে ছিল না। এর কারণ কী?
ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের : গত ৫৪ বছরে ভালো-খারাপ অবস্থার মধ্যেই ছিলাম। তবে খারাপ অবস্থায় থাকার কারণ হলো মূলত আদর্শগত। বাংলাদেশের রাজনীতি অনেক সময়ই ইসলামপন্থার বিরোধী ধারায় পরিচালিত হয়েছে। যারা এ দেশে ক্ষমতায় এসেছে বিশেষত আওয়ামী লীগ, তারা আদর্শিকভাবে আমাদের মতো ইসলামভিত্তিক রাজনীতি গ্রহণ করতে চায়নি। এর পেছনে ভারতের ভূমিকাও বড়। ভারত কখনোই ইসলামপন্থি কোনো শক্তিকে সমর্থন করে না। বরং তারা সব সময় চেষ্টা করে মুসলমানদের সংগঠিত রাজনীতিকে দুর্বল রাখতে। ভারতের চারপাশে নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার-এ দেশগুলোতেও তাদের প্রভাব আছে, কিন্তু বাংলাদেশের মতো নয়। আমাদের দেশে তারা একশ্রেণির সুবিধাভোগী রাজনীতিককে নিজেদের পক্ষে নিয়ে এসেছে। তাদের বলা যায় ভারতের দালাল। তারা খুব অল্প মূল্যে নিজেদের বিক্রি করে দিয়েছেন। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থি চিন্তাধারা শুরু থেকেই চাপে থেকেছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রশিবির জোট না করেও বিশাল বিজয় অর্জন করেছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আপনাদের ভাবনা কী, আপনারা এককভাবে, নাকি জোটগত নির্বাচন করবেন?
ডা. তাহের : আমরা নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুত। তবে এবার আমাদের কৌশল একটু আলাদা। আমরা আনুষ্ঠানিক জোটে যাচ্ছি না। তবে ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ বা পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে কাজ করব। আমরা এটাকে বলছি ‘ওয়ান বক্স ভোটিং পলিসি’। এ নীতির অর্থ হলো, যে আসনে ইসলামপন্থি বা আদর্শিকভাবে ঘনিষ্ঠ প্রার্থীর জেতার সম্ভাবনা বেশি, সেখানে সবাই একসঙ্গে কাজ করবে। কোথাও জামায়াত, কোথাও ইসলামী আন্দোলন, আবার কোথাও বা সমমনা অন্যান্য দল। অর্থাৎ যে আসনে যাদের জনসমর্থন বেশি সে আসনগুলোতে ওই দলের প্রার্থী দেওয়া হবে। সবাই মিলে ওই প্রার্থীকে বিজয়ী হওয়ার জন্য কাজ করবে। শুধু সমমনা দলগুলো নয়, আমরা যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম সেসব রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। যারা এ সমঝোতায় আসতে চাইবে আমরা তাদের গ্রহণ করব। সে ক্ষেত্রে যদি ২০০ আসন ছেড়ে দিতে হয় তাতেও আমরা রাজি। আমাদের মূল লক্ষ্য ইসলামি মূল্যবোধ ও সুষ্ঠু রাজনীতির পক্ষে জনসমর্থন তৈরি করা।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : আগামী নির্বাচনে আপনাদের প্রত্যাশা কী? কেমন করবেন বলে মনে হয়?
ডা. তাহের : এ দেশের মানুষ পরিবর্তনের পক্ষে। আপনি যেখানে যান, রাস্তাঘাটে রিকশাচালক থেকে শুরু করে চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, অফিস-আদালত সর্বত্রই তারা বলছেন পরিবর্তন চান। পুরোনোর বদলে এবার নতুন দেখতে চাই। আমরাও আশাবাদী সব শ্রেণির মানুষ আমাদের ভোট দেবে। কারণ ৫ আগস্টের পর আমরা ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছি। কোথাও চাঁদাবাজি, দখলবাজি, লুটতরাজসহ অসামাজিক কার্যক্রমের সঙ্গে জামায়াতের লোকজন জড়িত হয়নি। এসব কারণে আমরা আরও বেশি আশাবাদী। সাধারণ মানুষ যদি ভোট দেয়, আর ভোট যদি সুষ্ঠু হয় তাহলে আমরা জয়ী হব ইনশাল্লাহ। জনগণের রায়ে আমরাই সরকার গঠন করতে পারব।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনারা জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট চাইছেন কেন?
ডা. তাহের : আমরা চাই জাতীয় নির্বাচনের আগে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার হোক। এজন্য আমরা নির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়েছি। এটা শুধু রাজনৈতিক দলের বিষয় নয়, এটা জনগণের অধিকার। দেশের মানুষকে জানতে হবে তারা বর্তমান ব্যবস্থার পরিবর্তন চায়, নাকি আগের মতোই সব চলতে দেবে। এ কারণেই আমরা বলেছি গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একসঙ্গে করা যাবে না। কারণ একই দিনে দুটি ভোট হলে মানুষ সংসদ নির্বাচনে মনোযোগ দেবে, গণভোট গুরুত্ব হারাবে। সংসদ সদস্য হওয়ার লড়াইটা তখন বেশি আলোচিত হবে, গণভোটে ভোট পড়বে খুব কম। তাই আমরা চাই আগে গণভোট হোক, মানুষ মতামত দিক। সংস্কারের পক্ষে যদি জনগণ রায় দেয়, তাহলে সে অনুযায়ী আইন সংশোধন করে নির্বাচন আয়োজন করা হোক।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একই দিনে হলে সমস্যা কোথায়?
ডা. তাহের : সমস্যা হলো মনোযোগের ভারসাম্য হারানো। ধরুন, একজন ভোটার কেন্দ্রে গেলেন, তিনি জানেন যে সংসদ নির্বাচনে তার এলাকার প্রার্থীই আসল বিষয়। গণভোটের ব্যালট হয়তো আলাদা থাকবে, কিন্তু তিনি সেটার গুরুত্ব ততটা বুঝবেন না। আমরা বলছি, যখন একই দিনে একাধিক ভোট হয়, তখন মানুষ ক্ষমতার ভোটকেই গুরুত্ব দেয়। গণভোট তখন দ্বিতীয় সারিতে চলে যায়। তা ছাড়া গণভোটের প্রচার ও ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার। মানুষকে বোঝাতে হবে সংস্কার মানে কী, কেন দরকার? এজন্য আলাদা সময় ও প্রক্রিয়া দরকার। এক দিনে সব মিলিয়ে দিলে সেটা অর্থহীন হয়ে যাবে। মানুষ নির্বাচনে ক্ষমতার ভোটের দিকে প্রাধান্য দেবে। কারণ সব দলই চাইবে তার প্রার্থীকে ভোট দিতে। সেখানে গণভোটের দিকে কেউ নজর দেবে না, এটাই বাস্তব। দিন শেষে দেখা যাবে গণভোট পড়েছে ৫%। তখন বিএনপি বলবে মানুষ গণভোট চায় না। এটা বাদ। তখন জুলাই সনদ আর আইনি ভিত্তি পাবে না।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : গণভোট আগে হলে জামায়াত কি লাভবান হবে?
ডা. তাহের : আমরা বলেছি, গণভোটের বিষয়টি কোনো দলের নয়, এটা জাতির ভবিষ্যতের বিষয়। যদি সংস্কার হয়, তাহলে সবাই লাভবান হবে। তখন প্রধানমন্ত্রী বা ক্ষমতাসীন কেউই সীমাহীন ক্ষমতা নিয়ে থাকতে পারবে না। ক্ষমতায় ভারসাম্য আসবে, জবাবদিহি বাড়বে। কিন্তু বিএনপি বিষয়টিকে এখনো রাজনৈতিক কৌশলের দৃষ্টিতে দেখছে। আর গণভোটে জমায়াতের আলাদা লাভ নেই, লাভ হবে দেশের।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : শোনা যাচ্ছে নির্বাচনে আপনারা দলের বাইরেও প্রার্থী দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। কতটা সত্য?
ডা. তাহের : দলের বাইরে প্রার্থী দেওয়ার বিষয়টি আমাদের চিন্তায় রয়েছে। আমরা খোঁজ করছি। সৎ, যোগ্য, দেশকে এগিয়ে নেওয়ার ভূমিকায় যারা কাজ করবেন তেমন কাউকে পেলে আমরা তাদের মনোনয়ন দেব। তবে এরই মধ্যে আমাদের সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠে কাজ করছেন। সে ক্ষেত্রে অন্য ধর্মাবলম্বী বা যোগ্য ব্যক্তিকে পেলে আমরা প্রয়োজনে প্রার্থী পরিবর্তন করব।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : জামায়াতের মতো সুশৃঙ্খল একটি দলে কয়েকটি আসনে আপনাদের মনোনীত এমপি প্রার্থী ও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে গ্রুপিং বা দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে। তাহলে কি অন্য দলগুলোর মতো আপনাদের মধ্যেও ক্ষমতার লোভ চলে আসছে?
ডা. তাহের : না, আমি তা মনে করি না। এসব আসলে নির্বাচন সামনে রেখে স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা। এগুলো পার্টির মূল কাঠামোর কোনো বিভাজন নয়। বরং আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি বা স্থানীয় সমর্থকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। আমাদের দল এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। যদি দেখা যায় কোনো প্রার্থী বা নেতা সরাসরি এসবে জড়িত, তাহলে ভবিষ্যতে তার প্রার্থী হওয়ার সুযোগ থাকবে না। জামায়াতে ইসলামী নিয়মশৃঙ্খলার ব্যাপারে খুব কঠোর।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ১৯৯৬ সালে জামায়াতকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একত্রে আন্দোলন করতে দেখা গিয়েছিল। সেই ঐক্যের ফলে আওয়ামী লীগ উপকৃত হয়। কিন্তু তারা ক্ষমতায় এসে জামায়াতের নেতাদেরই ফাঁসি দিয়েছে। এটা কি জামায়াতের রাজনৈতিক ভুল ছিল?
ডা. তাহের : অনেকে বলেন, ১৯৯৬ সালে আমরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্য করেছিলাম এটা পুরোপুরি সত্য নয়। আমরা আসলে বিএনপির বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে আন্দোলনে ছিলাম। আওয়ামী লীগও তখন একই আন্দোলনে ছিল। ফলে অনেকে সেটাকে ঐক্য হিসেবে দেখেছে। আর ওই সময় বিএনপি আমাদের সংসদে মাত্র ১৬টি আসন দিতে চেয়েছিল। আমরা সেটা মেনে নিইনি। ফলে আলাদাভাবে নির্বাচন করেছি। এতে বিএনপি ওই নির্বাচন হেরেছে। ওই নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেছে, ৫২টি আসনে বিএনপি ২ থেকে ১০ হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরেছে। যদি ওই সময় আমাদের বিএনপি সঙ্গে রাখত, তাহলে তারা নিশ্চিত জয় পেয়ে সরকার গঠন করতে পারত। তবে এজন্য দুই দলই দায়ী। কিন্তু বেশি দায়ী বিএনপি। আমার মতে বিএনপির একগুঁয়েমিও এখানে দায়ী। রাজনীতিতে অহংকার বা জিদ কখনোই ভালো ফল বয়ে আনে না।