শিরোনাম
শুক্রবার, ২৬ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

ইসলামের চার খলিফা

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

ইসলামের চার খলিফা

নবীজির পরীক্ষিত বন্ধু হজরত আবু বকর

  ‘অনেকক্ষণ তো পথ চললাম। এবার একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার।’

‘হ্যাঁ! উটগুলোও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।’

‘ওই যে দেখুন একটি বড় গাছ দেখা যাচ্ছে। ওখানে তাঁবু ফেললে কেমন হয়।’

মরুভূমিতে গাছের কথা শুনে কিছুটা অবাক হলেন। কপালের কাছাকাছি হাত উঠিয়ে দূরের গাছকে দেখার চেষ্টা করলেন। গাছ দেখেই কণ্ঠে আনন্দের রেশ ছড়িয়ে বললেন, বাহ! দারুণ তো। একটি বাড়িও দেখা যাচ্ছে। ওখানেই তাঁবু ফেলতে বলুন সবাইকে।

কাফেলাটি এসেছে মক্কা থেকে। যে দুজনের কথা শুনছিলেন, একজনের নাম মুহাম্মদ। আরেকজনের নাম আবু বকর। দুজনেই পাকা ব্যবসায়ী। মুহাম্মদের বয়স ২০ বছর। আবু বকরের আঠারো। মরুর সন্তানরা এ বয়সেই পৃথিবীকে জয় করার স্বপ্ন দেখে। নিজেকে তৈরি করে ব্যবসায়ী এবং যোদ্ধা হিসেবে। এ দুই তরুণ অল্প সময়েই বেশ এগিয়েছেন। দেশের গন্ডি পেরিয়ে ব্যবসার পসার ঘটিয়েছেন আন্তর্জাতিক বাজারেও। সিরিয়ার সীমান্ত পার হওয়ার সময় বিশ্রামের কথা বলছিলেন একজন আরেকজনকে।

গাছটি বেশ বড়সড়ই। চারদিক পাতায় ঘেরা। বিশ্রামের জন্য শ্রেষ্ঠ জায়গা কোনো সন্দেহ নেই।

আবু বকর বললেন, ‘মুহাম্মদ! আপনি বিশ্রাম নিন। আমি চারপাশটা ঘুরে দেখি।’ একটু সামনে এগিয়ে যেতেই পথের ধারের নির্জন বাড়ি থেকে এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন। ‘পথিক! আমার বাড়ির মেহমান হও।’ আরবদের চিরাচরিত নিয়ম। মেহমানদারিতেই তাদের আনন্দ। আবু বকর বললেন, আপনাকে তো চিনতে পারলাম না। বৃদ্ধ মুচকি হেসে বললেন, আমার নাম নাসতুরা। ঐতিহাসিকরা কেউ কেউ বৃদ্ধের নাম বুহাইরা বলেও উল্লেখ করেছেন। আবু বকর একটু নড়েচড়ে উঠলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আপনিই কি সেই প্রখ্যাত ধর্মযাজক নাসতুরা? মৃদু ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন বৃদ্ধ।

ধর্মের বিভিন্ন বিষয়-আশয় নিয়ে কথা হলো দুজনের মধ্যে। একটু পর বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, ওই যে গাছের নিচে বসে আছে যে তরুণ, তাঁর নাম কি মুহাম্মদ? আবু বকর আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলেন, আপনি কীভাবে জানলেন হে শায়েখ? নাসতুরা বললেন, পবিত্র ইঞ্জিল শরিফে তাঁর কথা এত বিস্তারিত এসেছে যে, দূর থেকে দেখেও তাকে চিনতে আমার কোনো অসুবিধে হয়নি। তোমার এ বন্ধুই শেষ যুগের পয়গম্বর হবেন। কথাগুলো বলার সময় বৃদ্ধের চেহারা থেকে আনন্দ ঠিকরে পড়ছিল। আরও কিছুক্ষণ পর বৃদ্ধ বললেন, অনেক তো কথা হলো। এবার সবাইকে ডাকো, খাওয়া-দাওয়া করা যাক।

আবু বকর বলেন, হে দুনিয়ার মানুষ শোনো! ধর্মযাজক নাসতুরার কাছ থেকে শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আমার হৃদয় মুহাম্মদকে নবী বলে মেনে নিয়েছে। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু মুহাম্মদ। আমার চেয়ে এত গভীরভাবে তাঁকে আর কেউ চেনে না। আল্লাহর কসম! তার ব্যক্তিত্বই বলে দেয়Ñ সে খোদার পয়গম্বর। ঐতিহাসিকরা বলেন, মুহাম্মদ (সা.) যখন নবুয়ত দাবি করেন তখন মক্কাজুড়ে হৈ চৈ পড়ে যায়। শুরুর দিকে খুব কম মানুষই হজরতকে নবী বলে স্বীকার করেন। হজরতের জীবনের খুবই নাজুক অধ্যায় ছিল এটা। এত কঠিন সময়ও একমাত্র আবু বকরই নবীজির পাশে দাঁড়ান। নবীজি বলেছেন, আমি যাকেই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি, সে অল্পবিস্তর ভেবেছে, যাচাই-বাছাই করেছে। কিন্তু আবু বকরই একমাত্র ব্যক্তি যাকে দাওয়াতের সঙ্গে সঙ্গে কোনো ধরনের ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই আমার ধর্ম এবং রিসালাতকে মেনে নিয়েছে। নবীজি আরও বলেন, ইসলাম প্রচারে আবু বকর আমাকে যতটা সহযোগিতা করেছে, সব সাহাবি মিলেও এতটা সহযোগিতা করেনি। আবু বকরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক এত গভীর যে, তাকে না দেখে আমি এক দিনও থাকতে পারি না। আবার আমাকে না দেখলেও তার দিন কাটত না।

আবু বকরকে বলা হয় ইসলামের ত্রাণকর্তা। নবীজির মৃত্যুর পর দারুণ বিশৃঙ্খলা দানা বাঁধতে পারেনি শুধু আবু বকরের শাসন নৈপুণ্যের কারণে। একদিকে জাকাত না দেওয়ার দাবি, অন্যদিকে ধর্ম ত্যাগের হিড়িক, ছিল ভন্ড নবীর উৎপাতও-  এসব কিছু আবু বকরকে দাঁড় করিয়ে দেয় সীমাহীন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা এবং সিদ্ধান্তের দৃঢ়তার কারণে সব চ্যালেঞ্জে উতড়ে যান তিনি। কোরআন সংকলকের নাম হিসেবে সবাই উসমান (রা.)-কেই জানি। কিন্তু আসল কথা হলো, কোরআন সংকলন করেন আবু বকর (রা.)। ভ- নবী মুসায়লামার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অনেক হাফেজ সাহাবি শহীদ হন। তখন আবু বকর (রা.) যায়েদ ইবনে সাবেত (রা.)-এর নেতৃত্বে কোরআন সংকলনের কাজ হাতে নেন। পুরো কাজ তিনি যথাযথভাবে তদারক করেন। কোরআনের লিখিত কপি তার মেয়ে হাফসার কাছে রেখে দেন। পরবর্তীতে যখন হজরত উসমান (রা.) কোরআনের অনুলিপি করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন আবু বকর (রা.)-এর রেখে যাওয়া কপি হাফসা (রা.) থেকে নিয়ে অনুলিপি করেন। তো কোরআন সংকলনের এ মহান দায়িত্বের জন্যও উম্মাহ তাঁর কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবে।

ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) নবীজির জম্মের দুই বছরের কিছু বেশি সময় পর ৫৭২ সনে জম্ম গ্রহণ করেন। নবীজি তাঁর চেয়ে দুই বছরের বড় ছিলেন। নবীজির ওফাতের পর তিনি দুই বছর বেশি বেঁচেছিলেন। নবীজির ইন্তেকালের পরের দুই বছর তিনি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে মদিনার রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। ৬৩৪ সালের আগস্ট মাসে দুনিয়ার আবাস ছেড়ে আমাদের আসল আবাস আখেরাতের পথে পাড়ি জমান তিনি। রসুল (সা.)-এর রওজার পাশেই আবু বকর (রা.) এর কবর রয়েছে। আবু বকরের সততা-দৃঢ়তা, মিথ্যার সঙ্গে আপস না করার মানসিকতা আমাদের দান করুন হে আল্লাহ।

 

হজরত ওমরের মতো শাসকের প্রয়োজন আজকের দুনিয়ায়

তখন মক্কায় আঁধারের রাজত্ব। সত্যের আলো নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন আলোর দিশারি মুহাম্মদ (সা.)। বেশির ভাগ মানুষই তাকে প্রত্যাখ্যান করছে। অল্পস্বল্প যারা সত্যের আলোয় জীবন চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাদের সংখ্যা সব মিলিয়ে মাত্র চল্লিশের কিছু বেশি। প্রভাবশালী দু-একজন ছাড়া বাকি সবাই ক্রীতদাস, গরিব শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এই পরিস্থিতিতে ইসলামের দাওয়াত গোপনে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। নবীজিও তাই করছিলেন। প্রকাশ্যে সত্যের দাওয়াত তখনো শুরু করেননি হজরত। এমন সময় ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা।

মক্কার কুখ্যাত সন্ত্রাসী ওমর হজরতের গোপন দাওয়াতের কথা জেনে ফেলেছেন। একশ লাল উটের লোভে হজরতের মাথা কাটতে এসেছেন ওমর। ওমর-হজরত মুখোমুখি। ওমরের হাতে চকচকে তরবারি। হজরতের মুখে চিকমিক হাসি। আগের রাতেই হজরত কাতরকণ্ঠে প্রভুকে বলেছিলেন, ‘হে প্রভু! ইসলামের দাওয়াতে সহযোগিতার জন্য আবু জাহেল অথবা ওমরকে তুমি কবুল করে নাও।’ রাতে দোয়া। সকালে ওমর সামনে। এ যে দোয়া কবুলের ফল, নবীজি তা বুঝেছেন ওমর আসবে শুনেই।

মিষ্টি হেসে স্বাভাবিক কণ্ঠে নবীজি বললেন, ওমর! এসো! আমার চাদরে বসো। বলেই নিজের চাদর বিছিয়ে দিলেন হজরত। আগেই কোরআনের কিছু বাণী শুনেছিলেন ওমর। তখন হৃদয় তার অল্প অল্প কোরআনে সমর্পণ হয়েছিল। আর কোরআনের মানুষটি যখন নিজের চাদর বিছিয়ে তাকে বসতে বলেছেনÑ মনে আর কোনো সন্দেহ রইল না, ইনি খোদার পয়গম্বর ছাড়া আর কেউ নন। সন্ত্রাসী হলেও ওমরের ছিল সত্যকে মেনে নেওয়ার সুন্দর একটি মন। সঙ্গে সঙ্গে তরবারি ফেলে দিলেন হুজুরের পায়ের কাছে। বললেন, কোনো সন্দেহ নেই আপনিই আল্লাহর রসুল। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই।

মক্কায় বেশ হৈ চৈ পড়ে গেল। ওমরের মতো মানুষও ইসলাম গ্রহণ করেছে। কাফেরদের মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেল। এদিকে ইসলাম গ্রহণের পর থেকে ওমরের ভিতর এক আশ্চর্য পরিবর্তন এলো। কখনো কাউকে ভয় পায়নি ওমর। নির্ভীক মনের প্রশ্ন নিয়ে নবীজির দরবারে হাজির হয়েছেন ওমর। বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইলেন, আচ্ছা নবীজি! বলুন তো, আমাদের ধর্ম কি সত্য ধর্ম নয়? আমাদের প্রভু কি সত্য নয়? আপনি কি সত্য নবী নন? ওমরের কণ্ঠে কিছুটা ঝাঁজ মেশানো থাকলেও নবীজি খুব শান্ত কণ্ঠেই জবাব দিলেন, হ্যাঁ! কোনো সন্দেহ নেই আমাদের ধর্ম সত্য, প্রভু সত্য এবং আমি সত্য নবী। ওমর বললেন, আমরা যদি সত্য হই, তাহলে কেন লুকিয়ে আড়ালে-আবডালে সত্য প্রচার করতে হবে? যদিও সংখ্যায় আমরা কম কিন্তু আমরা সত্যের পক্ষে। আপনি অনুমতি দিন মক্কার অলিগলিতে সত্যের পক্ষে মিছিল করি। ওমরের সাহসিকতা নবীজিকে মুগ্ধ করল। নবীজি অনুমতি দিলেন। মাত্র চল্লিশজনের অল্প বেশি মর্দে মুমিন নিয়ে ওমরের নেতৃত্বে মিছিল বের হলো। এই মিছিল সত্য বিশ্বাসীদের আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে দিল বহুগুণ। আর মিথ্যাবাদী খোদাদ্রোহীদের অন্তরে কাঁপন ধরিয়ে দিল এক নিমেষেই। 

ওমর এতই বিচক্ষণ ছিলেন যে, কোরআনের সতেরটি আয়াত তার ভাবনার আলোকে নাজিল হয়েছে। মক্কার মানুষ দেদার মদ খেতো। তিনি দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! মদকে হারাম করে দিন। কিছুদিন পর আয়াত নাজিল হলো, মদে ভালোর চেয়ে মন্দই বেশি। তোমরা মদ্যপ অবস্থায় নামাজের কাছেও যেও না। ওমর (রা.) দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! মদের ব্যাপারে আমাদের স্পষ্ট করে বলুন। তারপর নাজিল হলো, হে বিশ্বাসীরা তোমাদের জন্য মদ হারাম করা হয়েছে। এমনিভাবে, মক্কায় পর্দার নিয়ম ছিল না। ওমর (রা.) বললেন, নবীজি! মেয়েরা এভাবে খোলামেলা চলে এটা আমার ভালো লাগে না। নবীজি বললেন, ওমর! আল্লাহ নিষেধ না করা পর্যন্ত আমি নিষেধ করতে পারি না। এমন সময় পর্দার আয়াত নাজিল করে নারীদের খোলামেলা চলা নিষেধ করা হলো।

বদরের যুদ্ধে বন্দী সৈন্যদের কী করবে তা নিয়ে তিন সদস্যের পরামর্শ সভা ডাকা হলো। ওমর-আবু বকর এবং নবীজি জরুরি বৈঠকে বসেছেন। ওমর বললেন, এরা শত্রুপক্ষ। এদের হত্যা করা যুদ্ধ আইনে বৈধ। তাই এদের হত্যা করুন। আবু বকর বললেন, আমাদের এখন অর্থের প্রয়োজন। জরিমানা নিয়ে এদের ছেড়ে দেওয়া হোক। রসুলেরও তাই মত ছিল। পরবর্তীতে যখন ওহুদের ময়দানে এই ছেড়ে দেওয়া সৈন্যদের হাতে মুসলিম বাহিনী চরম পরাজয়বরণ করল তখন আল্লাহ নবীজি এবং আবু বকরকে বলেন, এদেরকে হত্যা না করে ছেড়ে দেওয়াটা ছিল তোমাদের ভুল। তোমরা আখেরাতকে বাদ দিয়ে দুনিয়াকে প্রাধান্য দিয়েছ। তাই পরাজয় তোমাদের ঘায়েল করেছে। এসব কারণে নবীজি অকুণ্ঠচিত্তে ঘোষণা করেছেন, আমার পরে কেউ যদি বিশ্বনবী হতো, সে হতো ওমর।

হজরত আবু বকরের ইন্তেকালের পর মদিনার শাসনভার হজরত ওমরের কাঁধে পড়ে। ওমর হন আমিরুল মোমিনিন বা বিশ্বাসীদের নেতা। ওমরের শাসনব্যবস্থা আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও পঠিত। এতটা ন্যায় ও সাম্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ইতিহাসে আর কেউ এমনটি করতে পারেনি। কবি নজরুলের ওমর কবিতায় বড় দরদি ভাষায় ব্যথাভরা সুরে ফুটে উঠেছে ওমরের শাসনব্যবস্থার কথা। নিজের ছেলেকে পর্যন্ত ছাড় দেননি তিনি। মদপানের শাস্তি দিয়েছেন। বেতের আঘাতে জর্জরিত ছেলে এক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। শাস্তি তখনো শেষ হয়নি। কবরের গায়ে বাকি শাস্তি প্রয়োগ করেন ওমর। এমনিভাবে চাকরকে উটে বসিয়ে নিজে রশি টেনে ইতিহাসের পাতায় এঁকে দিয়েছেন সাম্যের সেরা ছবিটি।

৫৮৩ সনে মক্কার সম্ভ্রান্ত কোরাইশ বংশে জম্মগ্রহণ করেন ওমর (রা.)। বাবার নাম খাত্তাব। মায়ের নাম হানতামা। মক্কার আদি গোত্রে তিনি বসবাস করতেন। তার দাপট এতই বেশি ছিল যে, তার বাড়ির পাশে ছিল আকিব পাহাড়। পরবর্তীতে ওই পাহাড়ের নাম হয়ে যায় ওমরের পাহাড়। তিনি সাড়ে দশ বছর অর্ধপৃথিবী শাসন করে ৬৩ বছর বয়সে আখেরাতের পথে পাড়ি জমান। মদিনায় রওজাতুন্নবীর পাশে হজরত আবু বকরের কবর, তার পাশেই ঘুমিয়ে আছেন অর্ধপৃথিবীর ন্যায়পরায়ন শাসক হজরত ওমর। হে আল্লাহ! ওমরের মতো ন্যায়ের সৈনিক হিসেবে পৃথিবীর সব শাসককে কবুল করুন।

 

হে আল্লাহ হজরত উসমানের মতো দান করার তৌফিক আমাদের দিন

ইসলামের তৃতীয় খলিফা ছিলেন হজরত উসমান (রা.)। বাবার নাম আফফান। মায়ের নাম আরওয়া বিনতে কুরাইজ। রসুল (সা.) এর জম্মের ছয় বছর পর অর্থাৎ ৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে মক্কার সম্ভ্রান্ত কুরাইশ পরিবারে তিনি জম্মগ্রহণ করেন। রসুল (সা.) এর দুই মেয়েকে তিনি বিয়ে করার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেন। এ কারণে ইতিহাস তাকে ‘জুননুরাইন’র মতো দুর্লভ উপাধি দিয়েছে। জুননুরাইন মানে হলো দুই নূরের অধিকারী। রসুল (সা.) এর কন্যা রুকাইয়া ছিলেন উসমান (রা.) এর প্রথম স্ত্রী। রুকাইয়া মারা গেলে ছোট বোন কুলসুমকেও বিয়ে করেন তিনি। জুননুরাইন উপাধির রহস্য এটাই।

আরবের প্রথম সারির ধনী ছিলেন উসমান ইবনে আফফান (রা.)। তার ধন-দৌলত এতই বেশি ছিল যে, মানুষের মুখে মুখে তার নামের সঙ্গে ‘গনি’ শব্দটি উচ্চারিত হত। গনি মানে হলো বিত্তশালী-সম্পদশালী। প্রচুর সম্পদশালী হওয়ার কারণে আরবের নেতাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক খুবই ভালো ছিল। অথচ ওইসব নেতার চেয়ে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা। মুহাম্মদ (সা.) যখন ইসলামের আহ্বান নিয়ে এলেন, তখন সব প্রভাবশালী হজরতের বিরোধিতা করলেও উসমান (রা.) প্রথম সুযোগেই ইসলামের ছায়ায় নিজেকে সঁপে দেন। এ জন্য উসমান (রা.) প্রায়ই বলতেন, আমি হলাম প্রথম চারজন ইসলাম গ্রহণকারীর মধ্যে চতুর্থজন। আমার আগে আলী, যায়েদ এবং আবু বকর ইসলাম গ্রহণ করেন। আমি চতুর্থ ব্যক্তি হিসেবে ইসলামের রঙে নিজেকে রাঙানোর সুযোগ পেয়েছি।

উসমান (রা.) এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটিও খুবই মজার। মক্কার আরেক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবু বকর ছিলেন উসমানের পরম বন্ধু। আর আবু বকরের পরম বন্ধু ছিলেন নবীজি। একদিন আবু বকর আর উসমান বসে কথা বলছিলেন। এক পর্যায়ে আবু বকর বললেন, আমাদের সমাজ অন্যায়-অবিচারে ডুবে আছে। আমি-তুমি হাতেগোনা কয়েকজন জাহেলিয়াতের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিইনি, কিন্তু এভাবে সব সময় চলবে না। নিজে নিজে ভালো থাকলাম ঠিক আছে, কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজম্মকে ক্ষতি থেকে বাঁচাব কীভাবে? আমার বন্ধু আবদুল্লাহর ছেলে মুহাম্মদকে তো তুমি খুব ভালো করেই জানো। তিনি সমাজ বদলানোর কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। তিনি খোদার প্রেরিত দূত হিসেবে নিজেকে দাবি করছেন। আমি যতটুকু জানি, একজন পয়গম্বরের যতগুলো গুণাবলি থাকা দরকার মুহাম্মদের মাঝে তার সবগুলো গুণ রয়েছে। পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবেও তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে। আমি তাঁর ওপর ইমান এনেছি। আমার ইচ্ছে তুমিও তাঁর ওপর ইমান এনে সমাজ গড়ার কাজে নিজেকে বিলিয়ে দাও। ভবিষ্যৎ প্রজম্মকে দুর্নীতিমুক্ত সুস্থ সমাজ উপহার দেওয়া আমাদের সবার দায়িত্ব। ঘটনাক্রমে এ সময় আবু বকর এবং উসমানের পাশ দিয়ে রসুল (সা.) যাচ্ছিলেন। আবু বকরের কথা শুনে নবীজি বললেন, উসমান! তোমার বন্ধুর দাওয়াত মেনে নাও, আর খোদার জান্নাত কিনে নাও। সঙ্গে সঙ্গে উসমান (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন এবং দুনিয়ায় থাকতেই জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশ সাহাবির একজন হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।

উসমান (রা.) ইসলামের প্রয়োজনে অকাতরে ধনসম্পদ বিলিয়ে দিয়েছেন। বদর থেকে শুরু করে প্রতিটি যুদ্ধে তিনি সবার চেয়ে বেশি সম্পদ দান করেছেন। তাঁর সমপরিমাণ সম্পদ আর কেউ দিতে পারেনি। তাবুক অভিযানের সময় শতকরা হিসেবে আবু বকর শতভাগ সম্পদ খোদার রাহে বিলিয়ে দিলেও পরিমাপে উসমানই (রা.) সবচেয়ে বেশি সম্পদ দান করেছিলেন। তিনি নগদ এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা, এক হাজার উট এবং পঞ্চাশটি ঘোড়া দেওয়ার পাশাপাশি একহাজার সৈন্যের ভরণপোষণের ব্যয়ভার বহন করার দায়িত্বও নিয়েছিলেন। উসমান (রা.) যখন নবীজির সামনে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা রাখলেন, নবীজি এত খুশি হয়েছেন যে, হজরতের চোখ থেকে অনন্দাশ্রু ঝরছিল। বারবার মুদ্রাগুলো উল্টেপাল্টে দেখছিলেন আর এ বলে দোয়া করছিলেন, হে আল্লাহ! উসমানকে তুমি ক্ষমা করে দাও। উসমানকে তুমি মাফ করে দাও।

কোনো এক যুদ্ধে মুসলিম শিবিরে পানির তীব্র অভাব দেখা দিল। কাছের কুয়াটি কাফেরদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এ ছাড়া আশপাশে আর কোনো পানির উৎস ছিল না। রসুল (সা.) বললেন, তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে, যে কাফেরদের থেকে কুয়া অথবা পানি কিনে আনতে পারবে। উসমান (রা.) বললেন, হুজুর! আমি পারব। পরবর্তীতে অতি উচ্চমূল্যে কাফেরদের থেকে কূপটি কিনে তিনি নবীজিকে উপহার দেন। আর নবীজি তা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেন। এই ঘটনায় নবীজি দারুণ খুশি হয়ে বলেন, উসমান তুমি আমাকে বীরে মাউনার কূপটি দিলে, বিনিময়ে আমি তোমাকে জান্নাতে এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কূপ দেওয়ার ওয়াদা করছি।

হজরত আবু বকর এবং ওমর (রা.) এর খেলাফতের সময় উসমান (রা.) তাদের পরামর্শ সভার সদস্য ছিলেন। ওমর (রা.) শহীদ হলে উসমান (রা.) খেলাফতের দায়িত্ব নেন। প্রথম দুই খলিফার চেয়ে শেষের দুই খলিফার শাসন ব্যবস্থা ছিল খুবই নাজুক। একদল লোক ওমর হত্যার বিচার নিয়ে বিদ্রোহ শুরু করে। আরেক দল লোক উসমান (রা.) কে ভুল বুঝিয়ে সরকারি সম্পদের অপব্যবহার শুরু করে। ঐতিহাসিকরা বলেন, উসমান ছিলেন সহজ-সরল মনের মানুষ। তাই তাকে ধোঁকা দিয়ে তাঁর কাছের মানুষ এবং বিদ্রোহী গ্রুপ মিলেমিশে সাধারণ জনগণের চোখে তাকে চরম বিতর্কিত করে তোলে। তার বিরুদ্ধে কোরআন পুড়িয়ে ফেলা, সরকারি সম্পদের ব্যক্তিগত ব্যবহার করা, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদির মতো বড় বড় অভিযোগ পর্যন্ত ছিল। অভিযোগগুলো সত্যি ছিল না। কিন্তু বিদ্রোহীরাও থেমে ছিল না। একদিন জুমার নামাজের সময় এক বিদ্রোহী উসমান (রা.) কে বেধড়ক লাঠিপেটা করে। এতে করে খলিফা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। সব ধরনের খাওয়া-পরা থেকে তাকে বিরত রাখে বিদ্রোহী দল। এ সময় উসমান (রা.) খুব অসহায় হয়ে পড়েন। একাকী যন্ত্রণায় তিনি শুধু নবীজিকে ডাকতেন। দিনরাত সব সময় কোরআন পড়তেন। একদিন রমজান মাসের রাতে স্বপ্ন দেখেন নবীজি (সা.) বলছেন, আমার উসমান! তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। কাল আমার সঙ্গেই তুমি ইফতার করবে। সকালে বিদ্রোহীদের অতর্কিত আক্রমণে শাহাদতের অমীয় সুধা পান করেন ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান ইবনে আফফান (রা.)। আল্লাহতায়ালা উসমান (রা.)-এর মতো মন খুলে দান করার তৌফিক আজকের মুসলমানদের দান করুন।

 

জ্ঞানের দরজা হজরত আলী

মুসলিম জাহানের চতুর্থ খলিফা ছিলেন হজরত আলী (রা.)। তাঁর পিতা আবু তালিব ছিলেন আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিমের পুত্র। আলী (রা.) এর ডাক নাম আবু তুরাব। তিনি নবীজি (সা.) এর কন্যা ফাতিমা (রা.) কে বিবাহ করেন। তাঁর মাতার নাম ফাতেমা বিনতে আসাদ ইবনে হাশিম ।

হজরত আলী (রা.) এর বয়স ছিল তখন প্রায় ২২ বছর। আল্লাহতায়ালার নির্দেশে হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইয়াছরিবে হিজরত করার শেষ রাতে শত্রুদের চোখের সামনে দিয়ে নিরাপদে গৃহত্যাগ করলেন। যাওয়ার সময় হজরত আলী (রা.) কে আমানতের গচ্ছিত সম্পদ প্রদানের দায়িত্ব দিয়ে গেলেন। প্রত্যুষে শত্রুপক্ষ দেখল, রসুলুল্লাহ (সা.) এর বিছানায় হজরত আলী (রা.) নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে আছেন। নবীজি (সা.)-এর কোলে যিনি লালিত-পালিত হয়েছিলেন, নবীজি (সা.)-এর মুখে যিনি কোরআন পাক শ্রবণ করেছেন, নবীজি (সা.) এর কাছেই যিনি কুরআন শিক্ষালাভ করেছেন এবং বুঝেছেন। তাঁর জ্ঞান-গরিমা অতুলনীয় হওয়ারই কথা। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আমি জ্ঞানের শহর এবং আলী তার দরজা।’

হজরত উসমানের (রা.) শহীদ হওয়ার পর মদিনাতে বিশৃঙ্খলা এবং নৈরাজ্য বিরাজ করছিল। পাঁচ দিন যাবৎ রাজনৈতিক ডামাডোলের পর, মিসরীয় বিদ্রোহীদের নেতা ইবনে সাবা, হজরত আলী (রা.)-এর পক্ষে এই বলে রায় দেয় যে, তিনিই একমাত্র খলিফা হওয়ার অধিকারী। কারণ হজরত মোহাম্মদ (সা.) যার স্বপক্ষে একটি ওসিয়্যত করেছিলেন। ২৩ জুন ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে, হজরত উসমানের (রা.) মৃত্যুর ছয় দিন পর, হজরত আলী (রা.) মহানবী (সা.)-এর চতুর্থ খলিফা নির্বাচিত হন এবং জনগণ তাঁর হাতে একে একে বায়াত গ্রহণ করেন।

খেলাফত নির্বাচনের পরপরই তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী, মদিনা থেকে ইরাকের কুফায় সরিয়ে নেন, যা ছিল অধিকতর কেন্দ্রীয় একটি স্থান। খলিফা হওয়ার পরপরই তিনি জনগণের বিশেষ করে মহানবী (সা.) এর প্রভাবশালী সাহাবি যেমন হজরত তালহা (রা.) এবং হজরত যুবাইর (রা.) এর উত্থাপিত হজরত উসমান (রা.) এর হত্যাকারীদের যথা শিগগির শাস্তির জনপ্রিয় দাবির সম্মুখীন হন। হজরত আলী (রা.) ঘোষণা করেন যে, তাঁর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার রাষ্ট্রে শান্তি-শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপন করা এবং তার পরই তিনি হজরত উসমান (রা.) এর হত্যাকারীদের বিচারের সম্মুখীন করবেন। কিন্তু হজরত তালহা (রা.) এবং হজরত যুবাইর (রা.), হজরত আলী (রা.)-এর এই সিদ্ধান্তে রাজি হননি; তারা সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করা শুরু করেন। মুসলমানরা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের কথা বিস্মৃত হয়ে প্রতিশোধপরায়ণ ও একে অন্যকে হত্যার নেশায় মেতে ওঠে। ফলে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে উষ্ট্রের যুদ্ধ ও ৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিফফিনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। গৃহযুদ্ধে রসুল (সা.) কর্তৃক প্রত্যয়িত তালহা, যুবাইর ও অনেক বয়োবৃদ্ধ সাহাবিসহ লক্ষাধিক মুসলমান নিহত হন। কার্যত ইসলামী খেলাফত অত্যন্ত দ্রুত বিপদাপন্ন সময়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

সিফফিনের যুদ্ধের পর খারেজি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। তারা মুসলিম মিল্লাতের জাতীয় শত্রু হিসেবে হজরত আলী, মুয়াবিয়া ও আমর ইবনুল আস (রা.) কে চিহ্নিত করে তাঁদের একই দিন ও অভিন্ন সময়ে হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আসন্ন মাহে রমজানের ১৫ তারিখ ফজরের নামাজের সময় আক্রমণ পরিচালনার সময় নির্ধারিত হয়। আততায়ীরা নির্দিষ্ট সময়ে বয়োবৃদ্ধ তিন সাহাবির ওপর হামলা করে। সৌভাগ্যক্রমে আমর ইবনুল আস (রা.) অসুস্থতার কারণে সেদিন মসজিদেই যাননি। আর মুয়াবিয়া (রা.) আততায়ীর আক্রমণে সামান্য আহত হলেও বেঁচে যান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হজরত আলী (রা.) ৬৬১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি শাহাদতবরণ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। হজরত হাসান ইবনে আলী (রা.) তাঁর জানাজায় ইমামতি করেন এবং কুফা জামে মসজিদের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। সরলতা ও আত্মত্যাগের প্রতীক ছিলেন হজরত আলী (রা.)। মুসলিম জাহানের খলিফা হয়েও নিজ হাতে তাঁকে ও ফাতেমা (রা.) কে কাজ করতে হতো। দাস-দাসী কোনো দিনই তাঁর ঘরে ছিল না। ইতিহাসবিদ হিট্টি বলেছেন, আলী (রা.) ছিলেন যুদ্ধে সাহসী, পরামর্শদানে বিজ্ঞ, বক্তৃতায় স্বচ্ছ, সাবলীল, বন্ধুদের প্রতি অকপট এবং শত্রুদের প্রতি দয়াশীল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর