শুক্রবার, ২১ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

ভারতের ঐতিহাসিক যত মসজিদ

সাইফ ইমন

ভারতের ঐতিহাসিক যত মসজিদ

দিল্লির জামে মসজিদ

দিল্লির জামে মসজিদ বিশ্বজুড়ে নান্দনিক সৌন্দর্যমন্ডিত মসজিদগুলোর একটি। মসজিদের ফাটলে এবং তার সিঁড়ি ও গম্বুজের ওপরে শত শত পায়রার বসতি স্থাপন করার দৃশ্য চোখ জুড়িয়ে দেয়। জামে মসজিদে একসঙ্গে ২৫ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। দিনে মসজিদের সমৃদ্ধ স্থাপত্য নকশা অধ্যয়নের জন্য খোলা থাকে। মসজিদটির নির্মাণ কাজ ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় এবং ১৬৫৬-এ শেষ হয়। মসজিদ প্রাঙ্গণের তিন দিক থেকে উন্মুক্ত দ্বার রয়েছে। পূর্বদিকের দ্বারের ছাদটির ওপর মৌচাকের মতো খোদাই করা খিলান নির্মিত। বেশ কিছু ছোট সুদৃশ্য গম্বুজ দ্বারা সুসজ্জিত করা। নামাজের হলের দৈর্ঘ্য ৬১ মিটার প্রস্থ ২৭ মিটার। নামাজের স্থানের তাৎপর্যতার কারণে এটিকে  ১.২ মিটার উত্থাপিত করে বানানো হয়েছে। মসজিদের সামনের পিশ্তাকটি সাদা মার্বেলের ওপরে লাল বেলে পাথরের নকশা করা। পিশ্তাকের ওপরে খিলানযুক্ত ওয়ালের বেড়া করা এবং সামনের দুই  কোনায় চিকন  দুটি মিনার আছে।


আদিনা মসজিদ

আদিনা মসজিদ পশ্চিমবঙ্গের মালদহে অবস্থিত। স্থাপত্যকলায় সিরিয়ার উমাইয়া মসজিদের আদলে তৈরি আদিনা মসজিদ। এটি একসময় দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম মসজিদ হিসেবে সুপরিচিত ছিল। লোকমুখে কথিত আছে, এই মসজিদে একসঙ্গে ১ লাখ মানুষ নামাজ আদায় করতে পারতেন। তা অবশ্য আদিনা মসজিদের ধ্বংসাবশেষ দেখেই অনুমান করা যায়। এই মসজিদ কবে তৈরি হয়েছিল তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে খানিক মতভেদ থাকলেও মসজিদের পেছনের দেওয়াল থেকে পাওয়া একটা শিলালিপি থেকে জানা যায় সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের পুত্র এবং উত্তরসূরি সিকান্দার শাহ ১৩৭৩ সাল নাগাদ এই আদিনা মসজিদ নির্মাণ করিয়েছিলেন রাজকীয় মসজিদ হিসেবে। 

আদিনা মসজিদ ১৩৬৪ সালে কমিশন করা হয়। ষোড়শ শতাব্দীতে মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গ সালতানাত ভেঙে যায়। এই মসজিদ উত্তর-দক্ষিণে ৫২৪ ফুট লম্বা ও ৩২২ ফুট চওড়া। এতে ২৬০টি থাম ও ৩৮৭টি গম্বুজ আছে। মসজিদের নকশায় বাংলা, আরবি, ফার্সি ও বাইজেন্টাইন স্থাপত্য অন্তর্ভুক্ত। যদিও মসজিদটি তার আকারের কারণে দূর থেকেই দৃষ্টি কেড়ে নেয়। এই মসজিদের পরিকল্পনা দামেস্কের বড় মসজিদের অনুরূপ। মসজিদের পেছন থেকে একটি পাথরের শবাধার খুঁজে পাওয়া গেছে। অনেকের বিশ্বাস, সেখানে ছিল সুলতান সিকান্দার শাহের সমাধিকক্ষ। তবে ওখানে সুলতানের কোনো সমাধি ছিল না।


টিপু সুলতান মসজিদ

টিপু সুলতান শাহী মসজিদ কলকাতার একটি বিখ্যাত মসজিদ। ১৮৪২ সালে টিপু সুলতানের কনিষ্ঠ পুত্র প্রিন্স গোলাম মুহাম্মদ এই মসজিদটি নির্মাণ করান। অতীতে মসজিদে প্রার্থনাকারীদের অজু করার জন্য একটি বড় পুকুর খনন করা হয়েছিল। বর্তমানে এই পুকুরটির কোনো অস্তিত্ব নেই। এ মসজিদের অপর বৈশিষ্ট্য হলো এর প্রাঙ্গণে বিভিন্ন জাতের কবুতরের দীর্ঘদিনের বসবাস। নামাজিরা নামাজের পর নিয়মিত কবুতরদের খেতে দেন। কেউ চাইলে গোটা রমজান এখানেই কাটাতে পারেন। বর্তমানে অনেকেই শুয়ে-বসে কোরআন পাঠের মধ্য দিয়ে মসজিদ প্রাঙ্গণে দিন কাটাচ্ছেন। রমজান মাসে ব্যবস্থা থাকে ইফতারের। মসজিদটিতে নামাজ পরিচালনার জন্য একজন ইমাম ও মুয়াজ্জিন ছাড়াও দেখভালের জন্য রয়েছেন বেশ কয়েকজন। টিপু সুলতানের ১১তম ও কনিষ্ঠ পুত্র প্রিন্স গোলাম মুহাম্মদ তার বাবা টিপু সুলতানের স্মরণে মসজিদটি নির্মাণ করেন। মধ্য কলকাতার এসপ্ল্যানেড অঞ্চলে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে জমি কিনে প্রথম মসজিদটি নির্মাণ করেন তিনি, যা শেষ হয় ১৮৪২ সালে। ১৯৮০-এর দশকে মাটির নিচ দিয়ে কলকাতায় মেট্রোরেল নির্মাণের সময় মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।


পালাইয়া জুমা পল্লী

পালাইয়া জুমা পল্লী বিশ্বের চতুর্থ প্রাচীনতম মসজিদ। এটিকে ভারতের প্রথম মসজিদ হিসেবে মনে করা হয়। এই মসজিদটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১ হাজার বছরের ইসলামী ঐতিহ্য ও ইতিহাস। ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে অবস্থিত এটি। ইসলামী সংস্কৃতির জন্য পরিচিত এই মসজিদটি ৬২৮-৬৩০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল। এখানে ভ্রমণ করেছেন প্রখ্যাত বিশ্বপর্যটক ইবনে বতুতা। তিনি তার ভ্রমণ গ্রন্থে বলেন, এটা হচ্ছে সেই জায়গা যেখানে সবচেয়ে বেশি আরব ঔপনিবেশিকরা বাস করেন এবং তিনি তাদের সেখানে আরব ভূমি হিসেবে বসবাস করতে দেখে বিস্মিত হন। তাই এই মসজিদসহ শহরের অন্য মসজিদগুলো দ্রাবিড় ইসলামী স্থাপত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। প্রাক ইসলামী যুগে মুহাম্মদ- এর সময়ে ইয়েমেনের গভর্নর বাধান (বাযান ইবনে সাসান)-এর আদেশে পান্দিয়া রাজ্যে ইয়েমেনের বণিক ও বাণিজ্য ঔপনিবেশিকরা এই মসজিদ নির্মাণ করেন। ১১ শতাব্দীতে শাহিদ যুদ্ধের পর মসজিদটি পুনর্নির্মিত হয়। বাযান ইবনে সাসান, তামিম ইবনে যায়দ আল আনসারি, নাগুর আবদুল কাদির, এরভাদি ইব্রাহিম শাহিব, অটোম্যানের সুলতান মুরাদসহ আরও অনেক বিখ্যাত মানুষ এই মসজিদে এসেছিলেন।


মতি মসজিদ

শিল্পী ভাসিলি ভেরেশচাগিন ১৯শ শতাব্দীতে মতি মসজিদের একটি চিত্রকর্ম সৃষ্টি করেন। মতি মসজিদ সম্রাট শাহজাহান নির্মাণ করেন। আগ্রা দুর্গে অবস্থিত এই মতি মসজিদ আনিন্দ্য সুন্দর এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। মুঘল সম্রাটদের আমলে প্রচুর মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে মুঘল স্থাপত্য তার স্বর্ণযুগে প্রবেশ করে। এই সময় নানা স্থানে নানা রকম স্থাপত্যশিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে অন্যতম এই মতি মসজিদ। মুক্তার মতো দ্যুতির জন্য এই মসজিদের নাম মতি মসজিদ হয়েছে। মতি মসজিদের বাইরের দৃশ্যও অত্যন্ত মনোরম। চারপাশে সবুজ দিয়ে ঘেরা। মতি মসজিদ আগ্রা দুর্গের দিওয়ান-ই-আম কমপ্লেক্সের উত্তরে অবস্থিত। এর গম্বুজ সংখ্যা তিন। এগুলো মার্বেল নির্মিত ও লাল বেলেপাথরের দেয়ালের ওপর অবস্থিত। মসজিদটি নির্মাণে ১ লাখ ৬০ হাজার রুপি খরচ হয় এবং এতে চার বছর সময় লেগেছিল।


অনন্য নিদর্শন বিখ্যাত কাটরা মসজিদ

ভারতের মুর্শিদাবাদ রেল স্টেশনের পূর্ব দিকে কাটরা মসজিদ অবস্থিত। মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন এই কাটরা মসজিদ দেখতে নিয়মিত শত শত দেশি-বিদেশি পর্যটক আসেন। অপূর্ব সুন্দর এই মসজিদটির প্রধান প্রবেশ দ্বারে ঢুকতেই চোখে পড়বে সবুজ বাগান। দুই পাশের দুই উঁচু বুরুজ অনেক দূর থেকেই দেখতে পাওয়া যায়। চোখ জুড়িয়ে যায় লাল ইট দিয়ে নির্মিত স্থাপনাটি দেখে। ঢাকা থেকে ১৭১৭ সালে রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করেন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁন। তার নামানুসারে নতুন রাজধানীর নাম হয় মুর্শিদাবাদ। এই কাটরা সমজিদের কাটরা মানে বাজার। রাজধানী স্থানান্তরিত করার পর নবাবের ইচ্ছা অনুযায়ী বাজারের মধ্যে নির্মাণ করা হয় মসজিদ। নবাব এটি নির্মাণের দায়িত্ব দেন বিশ্বস্ত কারিগর মুরাদ ফরাস খাঁনের ওপর। মসজিদটি চতুর্ভুজাকৃতির। সামনের দিকে রয়েছে পাঁচটি প্রবেশ খিলান। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতেই চোখে পড়বে পাঁচটি গম্বুজ। চার কোণে চারটি বুরুজ। সিঁড়ি বেয়ে বুরুজের ওপরে পর্যন্ত যাওয়া যায়। মসজিদের সামনের বুরুজগুলো ৭০ ফুট উঁচু এবং প্রায় ২০ ফুট চওড়া। বর্তমানে দুটি বুরুজ টিকে আছে। মসজিদের তত্ত্বাবধান ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আর্কিওলজিক্যাল সারভে অব ইন্ডিয়া এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ওপর।


সর্ববৃহৎ মধ্যপ্রদেশের তাজ-উল মসজিদ

ভোপালে অবস্থিত তাজ-উল মসজিদ। এটি ভারতের সর্ববৃহৎ ও এশিয়ার অন্যতম বড় মসজিদ। মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের শাসনামলে নবাব শাহজাহান বেগম মসজিদটির নির্মাণ শুরু করেন। কিন্তু তিনি পুরোপুরি নির্মাণ কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে তার মেয়ে সুলতানা জাহান বেগম তার জীবদ্দশায় এর কাজ অনেকটাই এগিয়ে নেন। তবে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর ফান্ডের অভাবে মসজিদটির নির্মাণ অসমাপ্ত থেকে যায়। ১১৪ বছর পর ১৯৭১ সালে আল্লামা মুহাম্মদ ইমরান খান নদভি আজহারি এবং মাওলানা সাইয়্যেদ হাসমত আলী ফের এর নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ১৯৮৫ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হয়। মসজিদের ভিতর ও বাইরে মিলে এক লাখ ৭৫ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন। দিল্লির জামে মসজিদ এবং লাহোরের বাদশাহী মসজিদের মতো এই মসজিদে গোলাপি রঙের মার্বেল পাথরের তিনটি গম্বুজসহ দুটি ১৮তলা উঁচু অষ্টভুজ মিনার রয়েছে। মূল হলওয়েতে মুঘল স্থাপত্যের মতো আকর্ষণীয় স্তম্ভ এবং মেঝেতে চিত্তাকর্ষক মার্বেল রয়েছে। মসজিদের প্রাঙ্গণে একটি বিশাল ট্যাংক রয়েছে। মসজিদটির একটি দ্বিতল ফটক রয়েছে।  তাবলিগের ইজতেমা তাজ-উল-মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।


ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত প্রথম মসজিদ চেরামান জামে মসজিদ

ইসলাম প্রচারের জন্য ও ব্যবসায়িক কর্মকান্ডের কারণে রসুলে কারিম (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই এখানে ছুটে আসেন সাহাবায়ে কিরাম। সেই সুবাদে ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত প্রথম মসজিদ। দেশটির কেরালা রাজ্যের ত্রিসুর অঞ্চলের চেরামান জামে মসজিদ। মসজিদটির সম্মুখভাগে স্থাপিত শিলালিপি অনুযায়ী পঞ্চম হিজরি মোতাবেক ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে সাহাবি মালিক বিন দিনার (রা.) মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানীয়দের কাছে মসজিদটি ‘চেরামান জুমা মসজিদ’ নামে পরিচিত। মালিক ইবনে দিনার ছিলেন এই মসজিদের প্রথম ইমাম। তাঁর পরবর্তী সময়ে হাবিব ইবনে মালিক ইমাম নিযুক্ত হন। একাদশ শতাব্দীতে মসজিদটির সংস্কার ও পুনর্র্নির্মাণ করা হয়। ক্রমান্বয়ে মুসল্লিদের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ১৯৭৪, ১৯৯৪ ও ২০০১ সালে মসজিদের সামনের অংশ ভেঙে আয়তন সম্প্রসারিত করা হয়। প্রাচীন মসজিদের অভ্যন্তরীণ অংশ, মিহরাব ও মিনার এখনো আগের মতো অক্ষত রয়েছে। মসজিদের বহির্ভাগ কংক্রিট দিয়ে তৈরি হয়। অজু করার জন্য তখনকার নির্মিত পুকুর এখনো আগের মতো আছে। মসজিদের পাশঘেঁষা খালি জায়গায় দুটি কবর বিদ্যমান। মনে করা হয়- একটি হাবিব ইবনে মালিকের, অপরটি তাঁর স্ত্রী মুহতারামা হুমায়রার। মসজিদটির ভিতরে পিতলের নির্মিত একটি প্রদীপ রয়েছে। এটি হাজার বছর ধরে প্রজ্বলিত রয়েছে। তবে এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা নিয়ে কিছুটা বিতর্ক রয়েছে। মসজিদটির প্রতিষ্ঠাতা মালিক দিনার ছিলেন এক মুসলমান ব্যবসায়ী এবং ধর্মপ্রাণ মানুষ। মালিক দিনার শুধু এই মসজিদটিই নয়, বরং কেরালার বিভিন্ন অংশে আরও কয়েকটি মসজিদ প্রতিষ্ঠার জন্য বিখ্যাত। কিছু ইতিহাসবিদ তাঁকে মালিক ইবনে দিনার নামের আরেকজন মুসলিম সুফি সাধকের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলার কারণে তাঁর অবদান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। মালিক ইবনে দিনার ছিলেন হজরত হাসান বসরি (র.) এর ছাত্র। যিনি কখনই ভারতবর্ষে আসেননি।

সর্বশেষ খবর