জোনাকী রানী। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার তোয়াকুল ইউনিয়নের শাহপুর গ্রামের জহর লালের মেয়ে। অসচ্ছল পরিবারের মেয়ে জোনাকীর সেই ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল পুলিশের ‘ইউনিফর্ম’ পরে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অংশগ্রহণের। এসএসসি পাশ করা জোনাকির সেই স্বপ্ন জানতেন বাবা জহর লালও। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের সাধ্য ছিল না তাদের। কারণ জহর লাল মানুষের কাছে শুনেছেন মেয়েকে পুলিশের চাকরিতে দিতে হলে কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা ঘুষ লাগবে। অথবা থাকতে হবে প্রভাবশালী মামা-চাচা কারো তদবির। জহর লাল বড় অসহায়। না আছে টাকা, না আছে তদবির করানোর মতো প্রভাবশালী আত্মীয়-স্বজন।
তবে, পরিবারের এই অসহায়ত্বের কাছে নিজের স্বপ্ন সঁপে দিতে চায় না জোনাকী। মনের জোর নিয়ে পুলিশ কনস্টেবল পরীক্ষার আবেদন করে। যথারীতি শারীরিক, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ধাপে ধাপে উত্তীর্ণ হয়। চূড়ান্ত ফলাফলে জোনাকীর স্বপ্ন ধরা দেয় হাতের মুঠোয়। নির্বাচিতদের তালিকায় উঠে জোনাকীর নাম। নিজের মেয়ে পুলিশ কনস্টেবল পরীক্ষায় পাশ করেছে সেটা যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না জহর লাল।
তার ভাষায়, ‘শুনলাম পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ লাগবে, শক্ত তদবির লাগবে। কিন্তু আমার মেয়ের তো কিছুই ছিল না। এভাবে যে পুলিশের চাকুরি হয়ে যায় এটা তো কল্পনাও করতে পারছি না। আসলে পুলিশের চাকুরি নিয়ে মানুষ বাইরে যা বলে তা মোটেই সত্য নয়। অফিসারদের কথাবার্তাও অনেক ভালো।’ চাকরির জন্য চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হওয়ায় বেজায় খুশি জোনাকিও। জানালো, ‘চাকুরির স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এখন দেশ আর মানুষের সেবা করার স্বপ্ন পূরণ করতে পারলেই বুঝবো আমি আমার স্বপ্ন শতভাগ পূরণ করতে পারছি।’
জোনাকির মতো পুলিশের চাকুরির স্বপ্ন ছিল জকিগঞ্জের বীরশ্রী ইউনিয়নের বদরপুর গ্রামের আবদুল হামিদের ছেলে জাবির আহমদের। ছোটবেলা থেকে জাবির স্বপ্ন দেখতো গায়ে পুলিশের পোশাক জড়ানোর। অন্যসব প্রার্থীদের মতো নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেয়ার আগে সেও জানতো চাকুরি পেতে হলে হয় লাগবে টাকা, না হয় তদবির। কিন্তু দুটোর কোনটি ছাড়াই সে নিয়োগ পরীক্ষায় ৮ম হয়েছে। জাবির জানালো পুলিশের চাকুরি পেতে তার সাকুল্যে ১২০ টাকা খরচ হয়েছে। টেলিটকের মাধ্যমে আবেদন করতে এই টাকা ফি হিসেবে দিয়েছে। এর বাইরে তার কাছে কেউ টাকা চায়নি। বাহিনীতে যোগ দিয়ে যাতে সততার সাথে কাজ করতে পারে সেই স্বপ্ন এখন জাবিরের।
একসময় টাকা বা তদবির ছাড়া পুলিশের চাকুরী ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু এখন নিয়োগ পরীক্ষায় এসেছে পরিবর্তন ও স্বচ্ছতা। ফলে ঘুষ লেনদেন কিংবা তদবির কোনটির মাধ্যমে চাকুরি দেয়া-নেয়ার সুযোগ নেই। কেবল মেধা আর যোগ্যতা দিয়েই চাকুরি পাচ্ছেন আবেদনকারীরা। এবছর সিলেটে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষায় আবেদন করেছিলেন ২ হাজার ৮৪৮ জন। তিনদিনের শারীরিক পরীক্ষা, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে পুলিশ কনস্টেবল হিসেবে নিয়োগে সুপারিশপ্রাপ্ত হন ৯৫ জন। এর মধ্যে ৮৪ জন পুরুষ ও ১১ জন নারী।
সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) মো. লুৎফর রহমান জানান, যারা চাকুরি পেয়েছেন তাদের মধ্যে ১৫ জন পিতৃহীন। ৪২ জন গরীব কৃষক পরিবারের সন্তান। এছাড়া নিয়োগপ্রাপ্ত ৯৫ জনের মধ্যে ৭৫ জনের পরিবারে এর আগে কেউ সরকারি চাকরিই করেনি।
নিয়োগ কমিটির প্রধান সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘পুলিশ মহা-পরিদর্শকের নির্দেশনায় সম্পূর্ণ মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। আশাকরি নিয়োগ প্রাপ্তরা আগামীতে দেশ সেবায় ও কর্মক্ষেত্রে নিজেদের মেধা ও যোগ্যতার পরিচয় দেবেন।’
বিডি প্রতিদিন/আবু জাফর