সোমবার, ১০ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত নারী শ্রমিক

নাটোর প্রতিনিধি

ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত নারী শ্রমিক

পুরুষের পাশাপাশি খেতে-খামারে কাজ করছেন নারী শ্রমিকরা। প্রত্যেকের কাজ ও কর্মঘণ্টা সমান। শুধু মজুরিতে তফাৎ। পুরুষের তুলনায় মজুরি কম পাচ্ছেন নারীরা। বছরের পর বছর এ বৈষম্য অব্যাহত। তবুও নারীদের এই কম মজুরিই বেঁচে থাকার স্বপ্ন। নারীদের ঘরে-বাইরে সবখানেই সামলাতে হচ্ছে। বিশেষ করে কৃষিকাজে নারীদের অংশগ্রহণ নিয়ে গ্রামে সমালোচনাও সইতে হয়। পাশাপাশি পুরুষদেরও যে তীর্যক মন্তব্য আছে, সেটি অস্বীকার করা যাবে না। বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সংসারের হাল ধরেছেন নারীরা। বলছিলাম নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার যোগীপাড়া গ্রামসহ বিভিন্ন গ্রামের নারী কৃষি শ্রমিকদের কথা। এ গ্রামের অন্তত ২০ জন নারী কৃষিখেতে দিনমজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। রমেজান বেগম কলেজপড়ুয়া দুই কন্যা সন্তানের জননী। তিন বছর আগে স্বামী হারিয়েছেন। পুরো সংসারের হাল তার কাঁধেই। কিন্তু পাঁচ শতকের ভিটা জমি ছাড়া সম্বল নেই। পরের খেতে দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। রমেজান বেগম জানান, স্বামী আবদুল জব্বার মারা যাওয়ার পর দিশাহারা হয়ে পড়ি। দুই মেয়েকে নিয়ে কী করব? এরপর সিদ্ধান্ত নিই পরের বাড়ি আর মাঠে কাজ করব। তিন বছর মাঠে কাজ করছি। বড় মেয়ে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে আর ছোট মেয়ে এইচএসসি প্রথম বর্ষে পড়ছে। আমি ছাড়া পৃথিবীতে ওদের কেউ নেই। ওদের জন্য আমার এত পরিশ্রম। কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠি। পরের বাড়িতে কাজ করি। সকাল সাড়ে ৬টায় মাঠে চলে আসি।

 বেলা দেড়টা পর্যন্ত সবজি খেতে কাজ করি। মজুরি পাই ২০০ টাকা। পুরুষের সঙ্গে একই জমিতে সমান কাজ করি। কিন্তু মজুরির বেলায় কম পাই। কিন্তু কিছু বলি না। সব নারী কম মজুরি পায়। কাজের সুযোগ পাচ্ছি, এটাই অনেক বড় ব্যাপার। রমেজান বেগম বলেন, মেয়েরা বাড়িতে রান্নার কাজে সহযোগিতা করে। বাকি সব কাজ আমিই করি। মেয়ে দুটি লেখাপড়া শেষ করলে, আমার আর কষ্ট থাকবে না। ওরা চাকরি করবে। সুদিন আসবে। ১৫ বছর আগে কৃষিকাজ শুরু করেন জোসনা বেগম। তখন মজুরি পেতেন ৫০ টাকা। এখন পান ২০০ টাকা। সময়ের ব্যবধানে তার মজুরি বেড়েছে। কিন্তু সেই মজুরিবৈষম্য এখনো আছে। বাড়ির কাজ সামলে কৃষিখেতে দিনমজুরের কাজ করছেন। স্বামী আছমত আলী পেশায় ভ্যানচালক। স্বামী-স্ত্রীর উপার্জনের টাকায় চলছে চার সদস্যের সংসার। জোসনা বেগম বলেন, অভাবের সংসার। স্বামীর উপার্জনে সংসার চলে না। তাই নিজেই মাঠের কাজে নেমে পড়েছি। প্রতিদিন সকালে প্রথমে সংসারের কাজ করি। সকাল ৭টার মধ্যে পরের সবজিখেতে কাজে চলে যাই। বেলা দেড়টায় কাজ শেষ হয়। সেখান থেকে বাড়িতে ফিরি। স্বামী-সন্তানের জন্য রান্না ও অন্যান্য কাজ করি। মাঠ ও বাড়ি দুই জায়গার কাজ একাই করি। পরের জমিতে কাজ করে ২০০ টাকা পাই। পুরুষের সমান কাজ করলেও মজুরি পাই না। পুরুষের চেয়ে ১০০ টাকা কম পাই। জমির মালিককে মজুরি বাড়াতে বললে সে জানায়, ‘তোমরা বিটি (নারী) মানুষ, বিটাদের (পুরুষ) মতো বোঝা বইতে পারো যে, তোমাদের সমান মজুরি দেব।’ সেলিনা বেগম বলেন, ‘মজুরি কম পেলেও বাড়ির পাশে জমিতে কাজ করতে পারি, এটাই আমাদের সুবিধা। মজুরি বেশি পেলে আমাদের খুব উপকার হতো। পুরুষ মানুষ বেশি কথা বলার সুযোগ পায় না। কিন্তু বাড়ির আশপাশের, কিংবা পাড়ার মহিলারা পিছু কথা বলে। অনেকে উপহাস করে। তাদের কথায় কিছু মনে করি না। না খেয়ে থাকলে কেউ আমাকে দেবে না।’ কথাগুলো বলছিলেন গালিমপুর মসজিদ মোড় এলাকার টুলু বেগম। তিনি সংসারের কাজের পাশাপাশি গ্রামে অন্যের সবজিখেতে কাজ করেন। ২০০ টাকা মজুরিতে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শ্রম দেন।  তিনি আরও বলেন, পুরুষ মানুষ যে কাজ করে, আমারও সেই কাজ করি। আমরা নিজের কাজ ভেবেই করি। কোনো অবহেলা করি না। অনেক সময় পুরুষরা কাজে অবহেলা কিংবা ফাঁকি দেয়। জমির মালিকরা আমাদের কাজে সন্তুষ্ট। কিন্তু মজুরি দেওয়ার সময় ঠিকই কম দেয়। বেঁচে থাকার জন্য কাজ করি। কম মজুরি দিলেও কিছু বলতে পারি না। শুধু জোসনা বেগম, রমেজান বেগম কিংবা টুলু বেগম নয়, তাদের মতো অনেকেই বছরের পর বছর মজুরিবৈষম্যের শিকার।

সর্বশেষ খবর