শিরোনাম
সোমবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ঘানি টেনেই স্বামী-স্ত্রীর জীবনযুদ্ধ

আবদুল লতিফ লিটু, ঠাকুরগাঁও

ঘানি টেনেই স্বামী-স্ত্রীর জীবনযুদ্ধ

দেশি সরিষা পেষাই করে তেল বের করার যন্ত্রকে ঘানি বা ঘানিগাছ বলা হয়। সাধারণত ঘানি টানার জন্য কলুরা গরু ব্যবহার করেন। তবে দরিদ্র খর্গ  মোহন সেনের গরু কেনার সামর্থ্য নেই। অভাবের সংসার। এক দিন ঘানি না ঘোরালে সংসারের চাকা  ঘোরে না। ১২৫০ গ্রাম তেল উৎপাদনে স্বামী-স্ত্রীর ঘানির জোয়ালে হাঁটতে হয় ৮ থেকে ৯ কিলোমিটার। ঘানি টেনে চলছে দরিদ্র দম্পতির জীবনযুদ্ধ! স্বামী-স্ত্রী মিলে কাঠের তৈরি কাতলার ওপর প্রায় ৪৫০ কেজি ওজন বসিয়ে ঘাড়ে জোয়াল নিয়ে ঘানি টানছেন দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে। ঘানির টানে ডালার ভিতর সরিষা পেষাই হয়ে পাতলানী দিয়ে  ফোঁটা ফোঁটা তেল পড়ে ঘটিতে। বাজারে বা গ্রামে  সেই তেল বিক্রি করতে পারলেই সংসার চলে তাঁদের। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গড়েয়া ইউনিয়নের গুয়াবাড়ি কিসামত এলাকার খর্গ মোহন  সেন ও তার সহধর্মিণী রিনা রানী সেন। তাঁদের তিন  ছেলে ও এক  মেয়ে রয়েছে। ভিটা বাড়িটুকুই সম্বল। মানুষকে নির্ভেজাল তেল খাওয়াবেন বলে বংশ পরম্পরায় এ পেশা তাঁরা এখনো ছাড়ছেন না। তাঁদের বংশের সবাই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। গ্রামের মানুষ এ পেশা ছেড়ে দিতে বলেন এবং মাঝে মধ্যেই কটূ কথাও বলেন। সব কিছু সহ্য করে বাপ-দাদার পেশা আগলে ধরে রেখেছেন। মেশিনের তৈরি সরিষার তেলের দাম বাজারে কম। ঘানি ভাঙা  তেলের দাম বেশি। সাধারণ মানুষ বেশি দামে ঘানির  তেল কিনতে চায় না। যারা ভেজালমুক্ত ঘানি ভাঙা খাঁটি সরিষার তেল কেনেন। সংখ্যায় তাঁরা একবারে খুবই কম। সদর উপজেলার গড়েয়া ইউনিয়নের গুয়াবাড়ি কিসামত গ্রামে এক সময় শতাধিক পরিবারের ঘানিগাছ ছিল। কালের বিবর্তনে আর ইঞ্জিনচালিত যান্ত্রিক চাকার কারণে ঘানিশিল্প এখন বিলুপ্তের পথে। গুয়াবাড়ি কিসামত গ্রামে একটি বাড়িতে ঘানিগাছ রয়েছে। খর্গ মোহন সেন ও তাঁর সহধর্মিণী রিনা রানী সেন ঘানিগাছের জোয়াল টানেন। খর্গ মোহন সেন বয়স প্রায় ৬০ বছর, তাঁর স্ত্রী রিনা রানী সেন বয়স ৫৫ বছর। এক সময় তাঁরা ঘানি ভাঙা ৬ থেকে ৭ কেজি তেল উৎপাদন করতে পারতেন। বয়সের কারণে আগের মতো শরীরের শক্তি নেই। হতদরিদ্র স্বামী-স্ত্রী এখন মাঝেমধ্যে নিজেরাই ঘাড়ে জোয়াল নিয়ে ঘানি টানেন। ১ থেকে ২ কেজি তেল উৎপাদন করতে পারলে বাজারে নিয়ে বিক্রি করে কোনোরকমে সংসার চালান। বয়সের ভারে মাঝেমধ্যে শরীর ভালো থাকে না। সে সময়টা দরিদ্র পিতা মাতাকে সন্তানের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় এক মুঠো ভাতের জন্য। সরেজমিনে গুয়াবাড়ি কিসামত গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িটিতে একটি ঘানিগাছ রয়েছে। সেটিতে তেল উৎপাদন হচ্ছে। রিনা রানী সেন এর স্বামী খর্গ মোহন সেন বাড়ির বারান্দায় বসে তেল মেপে দিচ্ছেন কামরুল হাসান নামের এক যুবককে। পাশের একটি ছোট্ট ভাঙা ঘরে ঘানি টানছেন রিনা রানী সেন। ঘানির ডালার  ভিতরে দেশি পাঁচ কেজি সরিষা দিয়ে প্রায় চার  থেকে ৫ ঘণ্টা যাবত ঘানি টেনে ১২৫০ গ্রাম পরিমাণ তেল উৎপাদন করেছেন। খৈল হয়েছে প্রায় তিন কেজি।

 দেশি সরিষার দাম এখন বেশি হওয়ায় প্রতি কেজি তেল বিক্রি করেন ৪০০ টাকায়। আর   খৈল বিক্রি করেন ৭০ টাকা কেজি দরে। গুয়াবাড়ি কিসামত এলাকার অশেষ রায় বলেন, এক সময় এ গ্রামে অনেক গাছ ছিল (ঘানিগাছ) এখন নেই বললেই চলে, বর্তমানে এই একটি বাড়িতেই রয়েছে। খর্গ মোহন সেন এর পরিবার অভাবগ্রস্ত, গরু কেনার সামর্থ্য নেই। ঘাড়ে জোয়াল নিয়ে স্বামী, স্ত্রী হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন। রিনা রানী সেন জানান, টাকার অভাবে গরু কিনতে পারি না, স্বামী-স্ত্রী নিয়ে এক জোয়াল টানি, একদিন জোয়াল টানতে না পারলে খাব কী? বয়স হচ্ছে, আগের মতো পারি না, দুটি না হলেও একটি গরু থাকলেও এমন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম স্বামী-স্ত্রীর করতে হতো না। মাঝেমধ্যে আমার বড় ছেলে ঘানি টেনে সহযোগিতা করেন। খর্গ মোহন সেন বলেন, আগের মতো দেশি সরিষা পাওয়া যায় না। গ্রামে ঘুরে ঘুরে সরিষা সংগ্রহ করি। তার পরও দাম বেশি। বাপ-দাদার সঙ্গে  জোয়াল (ঘানি) টানতে টানতে অন্য কোনো পেশা শিখতে পারিনি। প্রায় পাঁচ যুগ ধরে নিজে জোয়াল টানছি। এখন আর শরীর চলে না, স্ত্রীর সঙ্গে বড়  ছেলে জোয়াল টানে। একটি গরু থাকলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বংশ পরম্পরায় পেশাটি ধরে রাখতে পারতাম।

সর্বশেষ খবর