বগুড়ায় অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ছড়াছড়ি। বগুড়ায় ইচ্ছে মাফিক গড়ে উঠেছে অসংখ্য বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল ও প্যাথলজি সেন্টার। জেলা ও উপজেলা শহরের আনাচে কানাচে গড়ে ওঠা ক্লিনিকের অর্ধেকই কোন নিয়ম নীতি মানে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নীতিমালা বগুড়ায় বাস্তবায়ন না হওয়ায় কিছু নাম সর্বস্ব বেসরকারি ক্লিনিকে ভোগান্তি বেড়েছে রুগী ও তার স্বজনদের। লাভজনক ব্যবসা হওয়ায় জেলা শহর ও উপজেলা পর্যায়ে বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল ও প্যাথলজি সেন্টার গড়ে উঠছে বিনা বাধায়। যত্রতত্র গড়ে ওঠা এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই কোন অনুমোদন নেই। আবার কোন কোন প্রতিষ্ঠান চলছে মেয়াদত্তীর্ণ লাইসেন্স দিয়ে। নিবন্ধন (লাইসেন্স) ছাড়াই চলেছে প্রায় দুই শতাধিক ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার। আর জেলায় সরকারিভাবে অনুমোদিত হয়ে আছে ৩৩৮টি ক্লিনিক।
বগুড়া সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানানো হয়েছে, বগুড়া জেলায় নামে বেনামে সহস্রাধিক বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। জেলায় তালিকাভুক্ত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনেষ্টিক সেন্টার রয়েছে ৩৩৮টি। বাকিগুলো চলছে অনিয়ম করে। আবার কিছু হাসপাতাল ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও নতুন করে করে আর নবায়ন করেনি। তারপরেও এই সব বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে আছে। নিবন্ধন ছাড়া যেসব ক্লিনিক চলছে তাদের বড় অংশই দালাল এর মাধ্যমে রোগী ধরে থাকে। অনুমোদনহীন এসব ক্লিনিক ও ডায়গনষ্টিক সেন্টোরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার নামে অর্থ হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। চিকিৎসার নামে চলছে অরাজকতা। বিভিন্ন টেস্টের নামে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে বিপুল অর্থ। রোগীর চাপ থাকায় টেস্টের রিপোর্টও ভুল আসছে। পুনরায় টাকা খরচ করে টেস্ট করতে হচ্ছে। জেলা শহরের সবচেয়ে বেশি ক্লিনিক গড়ে উঠেছে ঠনঠনিয়া, শেরপুর রোড, বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সামনে, জেলা শহরের মফিজপাগলার মোড়ে।
শহরের এই চারটি স্থানে প্রাইভেট চেম্বার, ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ নামে বেনামে প্রায় ৩০০ ক্লিনিক রয়েছে। কিছু সুনামধন্য ক্লিনিক থাকলেও বেনামী ক্লিনিকের জন্য সুনাম নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া জেলার ১২টি উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রচুর পরিমানে ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। নামসবর্স্ব সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের নাম ভাঙ্গিয়েও চলছে এসব ক্লিনিক। এসব নামে বেনামে গড়ে ওঠা হাসপাতালে চিকিৎসা দিচ্ছেন আবার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকগণ। ক্লিনিকে ভালোমানের চিকিৎসার যন্ত্রাংশ ও রোগীর লাইফ সাপোর্ট দিতে পারে এমন সরঞ্জাম না থাকায় চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে অনেক সময় রোগীও মারা যাচ্ছে।
২০১৯ সালের ২৫ অক্টোবর ও একই বছরের ৯ এপ্রিল শহরের দুটি নামী ক্লিনিকে টনসিল অপারেশন করাতে গিয়ে দুটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। পৃথক দুই শিশুর মৃত্যুর পর পরিবার থেকে মামলা না করায় ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ সে যাত্রায় বেঁচে যান। ২৫ অক্টোবর ঠনঠনিয়ায় ডক্টরস ক্লিনিকে টনসিল অপারেশন করাতে গিয়ে তাওহিদ হোসেন ইয়া বাবু (১০) নামের শিশু মারা যায়। ওইদিন শিশু মৃত্যুর ঘটনায় অভিযুক্ত দুই চিকিৎসককে আটক করার পর মামলা না থাকায় পার পেয়ে যান দুই চিকিৎসক। ৯ এপ্রিল শহরের মালেকা নার্সিং হোমে হুমায়ারা নামে ৬ বছরের এক শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় শহরজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় হলেও ক্লিনিকগুলো এখনো রয়েছে আগের মতই বহাল।
চিকিৎসা সেবার নাম করে কিছু ক্লিনিক মালিক পক্ষ রোগিকে ঘিরে বাণিজ্য করে যাচ্ছেন। কোন রোগের কত টাকা ফি, কনসালটেন্ট ফি, অপারেশন ফি, অপারেশনকালে কি কি ওষুধ বা কত টাকার ওষুধ প্রয়োজন হয় তার হিসাব সাধারণ মানুষ জানেনা বলেই প্রতারিত হচ্ছে রোগীর স্বজনরা। ক্লিনিকগুলোতে রোগি ও রোগির স্বজনরা হয়রানির শিকার হলেও প্রতিকার না থাকায় মুখ বুজে থাকতে হচ্ছে রোগীর স্বজনদের। যে কারণে চিকিৎসা করাতে গিয়ে কাড়িকাড়ি অর্থ খুয়ে অনেকেই দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে। অথচ মানবিকতার কোন বালাই নেই ক্লিনিকগুলোতে। টাকায় মিলছে সব কিছু। বগুড়া জেলায় এসব কেউ দেখে না। যে কারণে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার নামে অনেকেই রোগিকে ঘিরে বাণিজ্য করে চলেছে।
বগুড়া জেলার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডাঃ শাহনাজ পারভিন জানান, গত ২৯ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর মোট চারদিন অভিযান চালিয়ে ২৩টি ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে নিয়ম নীতি না থাকায় তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জরিমানা করা হয়েছে ৬টি ক্লিনিক ও ডায়াগণস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে। এতে জরিমানা আদায় হয়েছে ১০ লাখ ৯০ হাজার। অভিযান অব্যহত রয়েছে।
বগুড়া জেলা প্রশাসক মোঃ জিয়াউল হক জানান, বগুড়ায় কোনভাবেই অবৈধ ক্লিনিক চলতে দেওয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউিনিটি ক্লিনিক করে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আর সেখানে অবৈধ ক্লিনিক স্থাপন করে অবৈধ ব্যবসা করতে দেওয়া হবে না। নীয়ম নীতি যেসব প্রতিষ্ঠান পালন করছে না বা রোগীর ভোগান্তি বাড়াচ্ছে সেসব বেসরকারি ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যহত থাকবে।
বিডি প্রতিদিন/এএ