বিদেশে কষ্টার্জিত আয় দেশে পাঠিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা এক কোটি প্রবাসীর উপরও এবার করের খড়্গ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণের কিস্তি পেতে সরকারকে দেওয়া শর্তে রেমিট্যান্সের ওপরই কর আরোপের প্রস্তাব উঠেছে। যেখানে এতদিন হুন্ডি রোধ ও বৈধ পথে অর্থ পাঠাতে উৎসাহ দিতে আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়া হতো, সেখানে আইএমএফের কর আরোপের ভাবনা অনেকের কাছেই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এ রকম একটি অজনপ্রিয় প্রস্তাবের পাশাপাশি রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে লোকসানি ব্যবসায় আরো বেশি হারে কর বসানোরও শর্ত দিয়েছে সংস্থাটি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রেমিট্যান্স প্রবাহে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। প্রতি মাসেই বাড়তি রেমিট্যান্স আসছে। এর সঙ্গে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার কারণেও রেমিট্যান্সে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩০.৩২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে, যা এর আগের অর্থবছরের তুলনায় ২৬.৮০ শতাংশ বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৩.৯১ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ডলার সংকট কাটাতে সরকার যখন রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়াতে মরিয়া, তখনই আইএমএফের এমন শর্তে প্রবাসীদের ‘পেটে লাথি’ দেওয়ার মতো অবস্থা হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এ বিষয়টি নিয়ে সরাসরি কাজ করেন এনবিআরের করনীতি বিভাগের সদস্য ব্যারিস্টার মুতাসিম বিল্লাহ ফারুকী। তিনি বলেন, ‘আইএমএফের রেমিট্যান্সের ওপর কর আরোপের প্রস্তাব গ্রহণ করার কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই। তারা অনেক কিছুই প্রস্তাব করে। আমাদের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় অনেক সময় অনেক কিছুই গ্রহণ করার মতো অবস্থা থাকে না। জাতীয় স্বার্থ মাথায় রাখতে হবে।’
আইএমএফের রেমিট্যান্সের ওপর কর আরোপের প্রস্তাব প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, ‘এটা আমার নলেজে নেই। আমাদের মতো দেশে আপাতত এটা সম্ভবও না। আমাদের ব্যালান্স অব পেমেন্ট ও রিজার্ভে সমস্যা আছে। আগে এগুলো ঠিক করে আদর্শ পরিস্থিতি তৈরি হলে এটা সম্ভব। এখন আইএমএফ চাইলেও আমরা রাজি হব না।’
রেমিট্যান্সে কর বসানোর প্রস্তাবের পাশাপাশি সংস্থাটি ব্যবসায় মন্দার সময়ও লোকসানি ব্যবসার ওপর আরো কর বসানোর শর্ত দিয়েছে। আইএমএফ বলেছে, কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লোকসান করলেও ন্যূনতম কর দিতে হবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এতে আরো চাপে পড়বে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। সংকুচিত হবে মূলধন।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট অনুযায়ী, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বছরে তিন কোটি টাকা বা এর বেশি টার্নওভার থাকলে তাকে ০.৬০ শতাংশ ন্যূনতম কর দিতে হবে। একজন ব্যবসায়ী তাঁর ব্যবসায়ে লোকসান করলেও তাঁকে এই কর দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। এই আইনকে আয়কর আইনের মূলনীতির পরিপন্থী উল্লেখ করে দীর্ঘদিন ধরে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, ‘ন্যূনতম করহার বাড়ালে ব্যবসায়ীদের করের বোঝা আরো বাড়বে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’
এ প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ট্যাক্সেশন নীতি অনুযায়ী ন্যূনতম কর অবশ্যই কালাকানুন। তবে সবার আগে দরকার শৃঙ্খলা। সবাই ঠিকমতো কর দিলে কোষাগার ভেসে যেত। কিন্তু কেউ ঠিকমতো কর দিচ্ছে না। সুশাসন ও ডিজিটাইজেশন নেই। ব্যাপক কর ফাঁকি থাকলে চাইলেও অনেক কিছু পরিবর্তন করা যায় না।’
শর্তসাপেক্ষে বাংলাদেশকে অনুমোদন করা ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের ষষ্ঠ কিস্তি ছাড়ের আগে এই অক্টোবরে ঢাকা সফরে আসবে আইএমএফের পরবর্তী মিশন। এই মিশন সামনে রেখে সংস্থাটি রাজস্ব আদায় বাড়াতে বিভিন্নভাবে চাপ দিচ্ছে। ভ্যাটে সব ধরনের পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে একক ভ্যাটহার (যেমন সবার জন্য ১৫ শতাংশ), আয়কর-ভ্যাট-কাস্টমস অনুবিভাগে পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন, তথ্যের আদান-প্রদান সহজীকরণসহ রাজস্ব আদায়ে মাঠ পর্যায়ে তদারকি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।
সৌজন্যে কালের কণ্ঠ