দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে ১,২০০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি থাকলেও বাজারে সরবরাহ সংকট ও অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণে ২০২৫ সালে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ১৪৫ টন, যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়েছে ১০৬ টন এবং আখাউড়া বন্দর দিয়ে ৩৯ টন।
মৌসুমের শুরু থেকেই ইলিশের দাম বেড়ে গেছে। গত বছরের তুলনায় আকারভেদে কেজিপ্রতি ২০০–১,০০০ টাকা পর্যন্ত দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্গাপূজার চাহিদা বৃদ্ধির কারণে নিষেধাজ্ঞার আগে কেজিপ্রতি ২০০–৪০০ টাকা বেশি দরে ইলিশ বিক্রি হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ বছর বাজারে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ কম ছিল। দাদন ব্যবসা, মধ্যস্বত্বভোগী এবং মজুদের কারণে খুচরা বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানিকারকরা অনুমতি পেলেও পর্যাপ্ত পরিমাণে ইলিশ রপ্তানি করতে পারেননি।
মৎস্য অধিদপ্তর ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অনুযায়ী, ইলিশ রপ্তানি শুরু হয় ২০১৯–২০ অর্থবছরে। সর্বোচ্চ রপ্তানি হয়েছে ২০২০–২১ অর্থবছরে, মোট ১,৬৯৯ টন। সর্বনিম্ন রপ্তানি হয়েছিল ২০১৯–২০ অর্থবছরে, ৪৭৬ টন।
চট্টগ্রামের কালুরঘাটভিত্তিক প্যাসিফিক সি ফুডস ৪০,০০০ কেজি রপ্তানির অনুমতি পেলেও মাত্র ১,৫৬০ কেজি রপ্তানি করতে পেরেছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক আবদুল মান্নান মনে করেন, 'স্থানীয় বাজারে দাম অনেক বেশি ছিল। ভারতের বাজারে মিয়ানমারের ইলিশের দাম বাংলাদেশের তুলনায় কম হওয়ায় তারা সেখান থেকে বেশি কিনেছে।'
মা ইলিশ সংরক্ষণের জন্য ৪ অক্টোবর থেকে ইলিশ আহরণ, পরিবহন, বিপণন ও মজুতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, যা চলবে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত।
নিষেধাজ্ঞার আগের দুই সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে এক কেজি থেকে সোয়া এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ২,২০০–২,৫০০ টাকায়। ৭০০–৯০০ গ্রামের ইলিশ ১,৮০০–২,০০০ টাকা, ৫০০–৬০০ গ্রামের ইলিশ ১,৪০০–১,৭০০ টাকা এবং ২০০–৪৫০ গ্রামের ইলিশ ৯০০–১,২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ছোট ঝাটকা ইলিশ ৬০০–৮০০ টাকায় পাওয়া গেছে।
গত বছরের আগস্টে দেড় কেজির বেশি ইলিশের দাম ছিল ১,৮০০–২,০০০ টাকা, এবছর আগস্টে তা ২,৮০০–৩,০০০ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে বড় ইলিশের দাম প্রায় ৫২% বেড়েছে। এছাড়া এক কেজি থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ ৮০০–৯০০ টাকা, ৭৫০ গ্রাম থেকে এক কেজি ৩০০–৩৫০ টাকা, ৫০০–৭৫০ গ্রাম ৪০০ টাকা এবং ছোট ইলিশ ২০০–২৫০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হয়েছে।
জেলে ও ব্যবসায়ীরা জানান, সমুদ্র ও নদীতে বড় ইলিশ কম থাকায় বাজারে ঝাটকা সরবরাহ বেশি, ফলে দাম বেড়ে গেছে। নোয়াখালীর হাতিয়ার চরচেঙ্গা বাজারের মাছ ব্যবসায়ী মান্নান রানা বলেন, 'সমুদ্রে ট্রলার পাঠাতে খরচ ৩.৫–৪ লাখ টাকা, কিন্তু বড় মাছ পাওয়া যায়নি।'
জেলেরা মাছ ধরা পর নদীর ঘাটে আনার পর আড়তদাররা নিলামের মাধ্যমে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। পাইকাররা খুচরা বাজারে পৌঁছে প্রতিটি স্তরে প্রায় ৬০% দাম বৃদ্ধি ঘটায়।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন ইলিশের দাম বৃদ্ধির ১১টি কারণ চিহ্নিত করেছে, যার মধ্যে রয়েছে চাহিদা-সরবরাহ ভারসাম্যহীনতা, মজুত ও সিন্ডিকেট, জ্বালানি ও পরিবহন খরচ, মাছ ধরার খরচ, নদীর নাব্য সংকট, অবৈধ জাল, দাদন, বিকল্প কর্মসংস্থান, নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরা, মধ্যস্বত্বভোগী কার্যক্রম ও রপ্তানির চাপ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জেলেদের প্রতি কেজিতে খরচ পড়ছে ৪৭১–৫০৪ টাকা। চার থেকে ছয় হাত ঘুরে ভোক্তাদের হাতে পৌঁছানোর আগে দাম হয় ৭০০–৩,০০০ টাকা পর্যন্ত।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, 'গত পাঁচ বছরে ইলিশ আহরণ প্রায় ১০% কমেছে। চলতি বছরের জুলাই ও আগস্টে আহরণ আগের বছরের তুলনায় যথাক্রমে ৩৩% ও ৪৭% কমেছে।'
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসেন বলেন, 'সরকারি তদারকি না থাকায় ব্যবসায়ীরা সরবরাহ ঘাটতির অজুহাত দেখিয়ে দাম বাড়াচ্ছে।'
নাব্যতা সংকট, ডুবোচর, দখল-দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও বাঁধ-সেতুর কারণে নদীতে ইলিশের বিচরণ কমেছে। চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আনিসুর রহমান বলেন, 'ইলিশ গভীর পানির মাছ। বাঁধ-দূষণ বাধা দিলে ইলিশ সমুদ্রে ফিরে যায়। বালি উত্তোলন ও দূষণের কারণে ইলিশের বিচরণ প্রভাবিত হচ্ছে।'
বিডি প্রতিদিন/আশিক