জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য শিগগিরই তদন্ত শুরু হচ্ছে। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাহী আদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা এ দলটির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা অভিযোগ যাচাইবাছাই চলছে। গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘অভিযোগ যাচাইবাছাই শেষে শিগগিরই তদন্ত শুরু হবে।’
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফসহ চার আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করা হয়েছে। গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। পরে অভিযোগ আমলে নেওয়ার বিষয়ে আদেশের জন্য আজকের দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।
এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পর প্রেস ব্রিফিং করেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। ব্রিফিংয়ে আইন উপদেষ্টার বিবৃতি উদ্ধৃত করে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আইন উপদেষ্টা কোথায় কী বলেছেন, তার জবাব আমার দেওয়া উচিত হবে না। আমাদের কাছে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়ে এনডিএম (ববি হাজ্জাজের নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন) নামে একটি রাজনৈতিক দল আগেই অভিযোগ দায়ের করেছে। আমরা তার ভিত্তিতে তদন্ত ইনিশিয়েট (শুরু করা) করছি।’ তিনি বলেন, ‘সুতরাং বলা যেতে পারে এ মুহূর্তে অপরাধী সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগকে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য প্রাথমিক তদন্তের কাজটি আমরা শুরু করতে যাচ্ছি। সেটা যদি পুরোদমে শুরু হয় তখন আমরা বলতে পারব আওয়ামী লীগকে বিচারের মুখোমুখি করার ব্যপারটা কত দূর গড়াচ্ছে।’ আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অভিযোগ এসেছে। আমরা এটা গুরুত্ব দিয়ে যাচাইবাছাই করছি। খুব শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু হবে।’ গত বছরের ৫ আগস্ট জুলাই অভুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে কয়েক দফা পরিবর্তন আনে অন্তর্বর্তী সরকার। গত বছরের ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধন এনে অধ্যাদেশ জারি করা হয়। পরে জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি দলের দাবির মুখে রাজনৈতিক দল-সংগঠনের বিচারের বিধান রেখে ফের সংশোধন আনা হয় আইনটিতে। ‘অধিকতর সংশোধন’ এনে চলতি বছরের ১১ মে দ্বিতীয়বার অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এ সংশোধন অনুযায়ী বিচারে কোনো দল বা সংগঠনের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণ হলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সেই দল বা সংগঠন নিষিদ্ধ করতে পারবে। শুধু তাই নয়, সংশ্লিষ্ট দল-সংগঠনের নিবন্ধন বাতিল, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার মতো শাস্তি আরোপ করার ক্ষমতা এ সংশোধনের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালকে।
হানিফসহ চারজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল : ২০২৪ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুব উল আলম হানিফসহ চারজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা দেয় প্রসিকিউশন। পরে বেলা পৌনে ১২টার দিকে বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২-এ এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগের ওপর শুনানি হয়। শুনানি শেষে আদেশের জন্য আজকের দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। এ সময় প্রসিকিউশনের পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম ও ফারুক আহাম্মদ উপস্থিত ছিলেন। হানিফ ছাড়া অন্য তিন আসামি হলেন কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগ সভাপতি সদর উদ্দিন খান, দলটির জেলা সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী এবং সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতা। পরে প্রেস ব্রিফিংয়ে এ বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ফরমাল চার্জে (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) আমরা মাহবুব উল আলম হানিফের ব্যাপারে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির অভিযোগে এনেছি। জুলাই আন্দোলনকারীদের জবাব দেওয়ার জন্য “ছাত্রলীগই যথেষ্ট”-ওই প্রেস কনফারেন্সে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে তিনি নিজেও উপস্থিত ছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘এ ছাড়া গত বছরের ২৯ জুলাই কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বৈঠকের মাধ্যমে আন্দোলন দমনের ষড়যন্ত্র এবং কুষ্টিয়া শহরে ছয়জনকে হত্যার দায়ে তাদের বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ আনা হয়। এ তিনটি অভিযোগ প্রমাণের জন্য সাফিশিয়েন্ট ম্যাটেরিয়ালসহ (পর্যাপ্ত প্রমাণাদি) সবকিছু দাখিল করেছে প্রসিকিউশন।’
আসামিদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্নের জবাবে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘গত বছরের ৫ আগস্টের পর পট পরিবর্তনের প্রথম সুযোগেই তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। এ কারণে তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তবে গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। যখনই তাদের গ্রেপ্তার করা যাবে, তখনই আদালতে উপস্থিত করা হবে। তারা উপস্থিত না থাকলে আইন অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
চানখাঁরপুল মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য ৯ অক্টোবর : জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আটজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ৯ অক্টোবর দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
গতকাল প্রসিকিউশনের ১৮তম সাক্ষী ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার লাইব্রেরিয়ান মো. আনিসুর রহমানের জবানবন্দি ও জেরা শেষে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১ এ আদেশ দেন। এ মামলায় এখন পর্যন্ত ১৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে।
সাক্ষ্য গ্রহণ কেন্দ্র করে এ মামলায় গ্রেপ্তার থাকা চার আসামিকে গতকাল ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তারা হলেন শাহবাগ থানার সাবেক ইন্সপেক্টর (অপারেশন) মো. আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন মিয়া, মো. ইমাজ হোসেন ইমন ও মো. নাসিরুল ইসলাম। পলাতক আসামিরা হলেন সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির সাবেক যুগ্মকমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলাম ও রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল। গত ১৪ জুলাই চানখাঁরপুলের মামলাটির পলাতক চার আসামিসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।