নতুনরা আসেন, আলো ছড়ান, আবার হঠাৎই মিলিয়ে যান। যারা কখনো ছিলেন টিভি পর্দার নিয়মিত মুখ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত নাম কিন্তু এখন তাদের অনেককেই আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কেন? উত্তর খুঁজলে উঠে আসে খামখেয়ালিপনা, ব্যক্তিগত জটিলতা, পেশাদারির অভাব, শেখার অভাব, অনুশীলনের অনীহা, ভিউনির্ভর বাজার আর তড়িঘড়ি তারকাবৃত্তির সংস্কৃতি। নাট্যজগতের অভিজ্ঞরা বলছেন, ‘শিল্প নয়, এখন সবাই দৌড়াচ্ছেন জনপ্রিয়তার পেছনে। খ্যাতি আর অর্থের পেছনে ছুটতে গিয়ে নতুন প্রজন্ম হারিয়ে ফেলছে অভিনয়ের গভীরতা ও দায়বদ্ধতা। টেলিভিশনের পর্দায় একসময় যেসব নবীন মুখ ঝলমল করে উঠেছিল, এখন তাদের অনেকে হারিয়ে গেছেন। কেউ শিডিউল ফাঁসিয়ে দেন, কেউ নেশায় জড়িয়ে পড়েন, কেউ প্রেম-বিয়ে নিয়ে আলোচিত হয়ে অভিনয় থেকে সরে যান। এমন নানা কারণে ঝরে পড়ছেন নবীনরা। কিন্তু কেন এমনটা ঘটছে? খোঁজ নিলে শিল্পী ও নির্মাতাদের বক্তব্যেই উঠে আসে কারণগুলোর এক ভয়াবহ চিত্র।
তারকাখ্যাতির লোভে হারিয়ে যাচ্ছে শিল্পীসত্তা
অভিনেতা আফজাল হোসেন মনে করেন, নতুনদের বড় সমস্যা তাদের লক্ষ্যচ্যুতি। ‘এখন যারা অভিনয়ে আসছে, তারা আসলে কী হতে চায়, সেটা নিজেরাও জানে না। অনেকেই অভিনয় শেখার চেয়ে তারকা হওয়ার স্বপ্নে ব্যস্ত। কিন্তু অভিনয়ের দক্ষতা ছাড়া সেই খ্যাতি স্থায়ী হয় না’, বলেন তিনি। অভিনয় শেখা ছাড়াই ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো এখন সাধারণ চিত্র-এ কথা বললেন দিলারা জামান। ‘তাড়াহুড়ো করে নাটক তৈরি হচ্ছে। যাদের অভিনয়ের প্রাথমিক ধারণাও নেই, তারাও যুক্ত হচ্ছে নাটকে। দায়সারাভাবে তৈরি গল্পে দর্শক কতক্ষণ আগ্রহ রাখবে?’, প্রশ্ন রাখেন তিনি।
পারিশ্রমিকের ভারসাম্যহীনতায় মানহীন নাটক
প্রবীণ অভিনেতা আবুল হায়াত মনে করেন, ‘নতুনদের দ্রুত জনপ্রিয় হতে চাওয়াটা শিল্পের মানকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ‘এখনকার নাটক কয়েকজন তারকাকেন্দ্রিক। নতুনরা এসেই চার-পাঁচ গুণ বেশি টাকা নিচ্ছে, কিন্তু অভিনয়ে ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। ভারসাম্য না থাকলে টিকে থাকা যায় না’, বলেন তিনি। অভিনেত্রী ও নির্মাতা রুমানা রশীদ ঈশিতা বলেন, ‘আগে একটা সিস্টেম ছিল, এখন সব ওপেন মার্কেট। কে কাকে চেনে, কার সঙ্গে যোগাযোগ আছে-এই নেটওয়ার্কের ওপর কাজ নির্ভর করছে। ফলে অনেক যোগ্য শিল্পী কাজ পাচ্ছেন না, কেউ কেউ আবার নিজের খামখেয়ালিপনায় হারিয়ে যাচ্ছেন।’
পেশাদারির অভাব
অভিনেতা তারিক আনাম খান নতুনদের প্রস্তুতিহীনতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘নতুন ছেলেমেয়েরা এক দিন কাজ করেই ভাবে, সে তারকা! কিন্তু স্ক্রিপ্ট না পড়ে সেটে আসে, কন্টিনিউটি ভুলে যায়, সময়মতো আসে না। এই মানসিকতা দিয়ে শিল্পী হওয়া যায় না।’ শহীদুজ্জামান সেলিম যোগ করেন, ‘অতিরিক্ত নাটক, কম বাজেট-সব মিলিয়ে মান কমে গেছে। নতুনদের মেধা আছে, কিন্তু কাজ দেখানোর মতো প্ল্যাটফর্ম নেই। ফলে তারা উঠে আসার আগেই হারিয়ে যায়।’
‘ভিউ’ বনাম ‘ভ্যালু’
নির্মাতা তৌকীর আহমেদ মনে করেন, নাট্যজগতে এখন সবচেয়ে বড় বিপদ হলো ‘ভিউর দৌড়’। ‘সবাই এখন সংখ্যার পেছনে। কে কত ভিউ পেল-এই হিসাবেই শিল্পের মান নির্ধারিত হচ্ছে। শিল্পীরা প্রস্তুতি ছাড়াই ক্যামেরার সামনে আসছে, ইন্ডাস্ট্রিও মেধার মূল্য দিতে পারছে না’, বলেন তিনি। অভিনেতা মোশাররফ করিম বলেন, ‘একজন শিল্পীকে কোনো না কোনো জায়গা থেকে গ্রুমিং করে আসতে হয়। মঞ্চ হলো সেই স্কুল। কিন্তু অনেকেই দুই-তিনটা কাজ করেই ভাবে, সে তারকা। দর্শক তৈরি করতে না পারলে সেই খ্যাতি বেশি দিন থাকে না।’
একই চরিত্রে আটকে থাকা
অপি করিম বলেন, একই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে অনেকে রাতারাতি জনপ্রিয় হয়। কিন্তু অন্যরকম চরিত্রে গেলে ব্যর্থ হয়। কারণ, তারা নিজেদের সীমার বাইরে যেতে পারে না। তাই খুব দ্রুতই হারিয়ে যায়।’ আজাদ আবুল কালাম যোগ করেন, ‘আমরা কাজকে ভালোবেসে করতাম, নতুনরা সেটা করছে না। কাজ শেখার আগ্রহ নেই, মনোযোগও কম। ক্ষণস্থায়ী খ্যাতির মোহে পড়ে অনেকেই নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছে।’
অভিজ্ঞ শিল্পীদের মতে নতুনদের টিকে থাকার পরামর্শ
অভিনয় শেখার জায়গা তৈরি : মঞ্চ, ওয়ার্কশপ বা প্রশিক্ষণ- যেখানেই হোক, শেখাটা অব্যাহত রাখতে হবে। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর আগে নিজেকে প্রস্তুত করাটা জরুরি।
খামখেয়ালি নয়, নিয়ম মানা : শিডিউল ফাঁসানো বা সময় না মানা পেশাদারির সবচেয়ে বড় শত্রু। দর্শক যেমন নাটক দেখে, নির্মাতা দেখেন শিল্পীর মনোভাব।
জনপ্রিয়তার পেছনে নয়, চরিত্রের গভীরে যেতে হবে : ভিউ, ট্রেন্ড বা লাইক নয়-অভিনয়টাই শিল্পীর আসল শক্তি। চরিত্র বুঝে অভিনয় করলে দর্শক নিজে থেকেই পাশে থাকবে।
সম্পর্ক নয়, দক্ষতা দিয়ে টিকে থাকতে হবে : ব্যক্তিগত যোগাযোগ কাজ এনে দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী করবে না। দক্ষতাই শেষ পর্যন্ত জায়গা করে দেয়।
অভিনয়কে ভালোবেসে পেশা : যারা অভিনয়কে শুধুই খ্যাতির শর্টকাট ভাবে, তারা বেশি দিন থাকে না। যারা ভালোবাসে, তারা হারিয়ে গেলেও ফিরতে জানে।
সব মিলিয়ে স্পষ্ট হয়, হারিয়ে যাওয়া নতুনদের গল্পটা কেবল ব্যক্তিগত ব্যর্থতার নয়-এটা গোটা শিল্পের কাঠামোগত দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি। শেখার পরিবেশ নেই, প্রযোজকদের পেশাদারির ঘাটতি আছে, আর দ্রুত জনপ্রিয়তার লোভে অনেকেই হারিয়ে ফেলছেন অভিনয়ের প্রতি দায়বদ্ধতা। তবু আশা রয়ে যায়-যদি ইন্ডাস্ট্রি মানসম্মত গল্পে ফিরে আসে, প্রশিক্ষণ ও পেশাদার মনোভাব বাড়ে, তবে নবীন প্রজন্মের শিল্পীরাও এক দিন দীর্ঘপথের যাত্রী হতে পারবেন।