পর্যাপ্ত ও মানসম্মত সিনেমা হল এবং দর্শকের অভাবে লোকসান গুনে বন্ধ হয়ে গেছে ৯৯ ভাগ চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকে চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা, নকল ও পাইরেসির দাপট শুরু হলে মধ্য, উচ্চমধ্য এবং উচ্চবিত্তের দর্শক সিনেমা হলে যাওয়া ছেড়ে দেয়। এতে সিনেমা হল মালিক এবং চলচ্চিত্র প্রযোজক উভয়েই চরম ক্ষতির মুখে পড়েন। দুই পক্ষই লোকসানের কবলে পড়লে একই সঙ্গে সিনেমা হল ও প্রযোজনা সংস্থা বন্ধ হতে শুরু করে। বর্তমান সময়ে চলচ্চিত্রশিল্প অস্তিত্ব বিপন্নের পথে এসে দাঁড়িয়েছে। চলচ্চিত্রশিল্পের এই দৈন্যদশা উপলব্ধি করে বিগত সরকার সিনেমা হলের উন্নয়ন, নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য ঋণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। এতে চলচ্চিত্র জগতে অনেকটা স্বস্তি ফিরে এলেও সিনেমা হল মালিকরা নতুন করে উদ্বেগে পড়েন। মধুমিতা সিনেমা হল ও মধুমিতা মুভিজের কর্ণধার ইফতেখারউদ্দীন নওশাদ বলেন, ঋণ নিয়ে সিনেমা হল সংস্কার করব ঠিক আছে, কিন্তু সেই ঋণ পরিশোধ করতে নিয়মিত পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবি প্রয়োজন। যা দীর্ঘদিন ধরে নেই। প্রতি সপ্তাহে চালানোর মতো ছবি যদি পাওয়া না যায় তাহলে এই ঋণ শোধ করব কীভাবে। এ কারণে সরকারের কাছে আমার অনুরোধ, সিনেমা হলের পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে লোকসান গুনে পথে বসা প্রযোজকরা আবার চলচ্চিত্র নির্মাণের মতো অর্থ কোথায় পাবে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র প্রযোজক টিওটি ফিল্মসের কর্ণধার চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম খসরু বলেন, চলচ্চিত্রশিল্পের দৈন্যদশার কারণে বিশাল অঙ্কের লোকসান গুনে ২০১৬ সাল থেকেই আমার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে আর ছবি নির্মাণ করতে পারছি না। ছবি নির্মাণ না করলেও নিয়মিত অফিস ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, স্টাফদের বেতনসহ সমুদয় খরচ বহন করতে হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। এতে অবস্থা নাভিশ্বাসে উঠেছে। এ অবস্থা শুধু আমার একার নয়, সব প্রযোজকের। প্রযোজকরা আগে বলতাম ‘প্রযোজক বাঁচলে সিনেমা হল বাঁচবে’, এখন বলছি ‘সিনেমা হল বাঁচলে প্রযোজক বাঁচবে’। সরকারের কাছে বিষয়টি একাধিকবার উত্থাপন করেছি। প্রযোজকদের যদি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া হয় তাহলে প্রযোজকরাও নিয়মিত মানসম্মত ছবি নির্মাণ করতে পারবেন এবং সিনেমা হলগুলোও পর্যাপ্ত ছবি পেয়ে তাদের ঋণ শোধ করতে পারবে। মানে নির্মাণ ও প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ভারসাম্য ফিরবে। ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রযোজকরা তাদের টোটাল ডিজিটাল রাইটস ব্যাংকের কাছে মর্টগেজ রাখবে। কারণ পরবর্তীতে কোনো প্রযোজক যদি ঋণ শোধ করতে না পারেন ব্যাংক তখন ওই প্রযোজকের ডিজিটাল রাইটস থেকে সহজেই ঋণের টাকা তুলে নিতে পারবে। সরকার যদি শুধু সিনেমা হলকে ঋণ দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সহযোগিতা না করে তাহলে ছবির অভাবে আবার সিনেমা হল বন্ধ হবে, সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং দেশে চলচ্চিত্রশিল্প বলে আর কিছুই থাকবে না। চলচ্চিত্র প্রযোজক ও কিবরিয়া ফিল্মসের কর্ণধার কামাল কিবরিয়া লিপু বলেন, ‘চলচ্চিত্র প্রযোজকরা দীর্ঘদিন ধরে করুণ অবস্থা পার করছেন। দর্শক খরা প্রযোজকদের পথে বসিয়ে ছেড়েছে। এখন সিনেমা হলকে টিকিয়ে রাখতে ও বন্ধ সিনেমা হলগুলোকে পুনরায় চালু করতে দরকার পর্যাপ্ত মানসম্মত ছবি। আর এর জন্য কমপক্ষে গত পাঁচ বছর যেসব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান নির্মাণে সক্রিয় ছিল তাদের যদি বছরে কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা করে দুই বছরে ২০০ কোটি টাকার স্বল্প সুদ ও সহজ কিস্তিতে ঋণ দেওয়া হয় তাহলে অবধারিতভাবে চলচ্চিত্রশিল্পের সুদিন ফিরে আসবে। চলচ্চিত্রের মানুষ ও দর্শক স্বস্তি পাবে এবং দেশের প্রধান গণমাধ্যম চলচ্চিত্রশিল্প আবার দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের জন্য সুনাম বয়ে আনবে। দেশ স্বাধীনের আগেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় স্থাপিত হয় চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থার অফিস। বঙ্গবন্ধুু এভিনিউ, তোপখানা রোড, নয়াপল্টন, কাকরাইল, গ্রিন রোড, সিদ্দিক বাজার, নবাবপুর, ওয়াইজঘাট, ইসলামপুর, গুলিস্তান, দিলকুশা, মতিঝিল, বিজয়নগর, ওয়ারী, পুরানা পল্টন, গুলশান, ধানমন্ডি, আরামবাগ, ফকিরাপুলসহ নানা স্থানে ছিল প্রযোজনা সংস্থার অফিস। ১৯৫৬ সালে এ দেশে প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ নির্মাণ হলে স্থাপিত হয় প্রযোজনা সংস্থার অফিস। ইকবাল ফিল্মসের ব্যানারে ছবিটি নির্মাণ করেন আবদুল জব্বার খান। তখন এই সংস্থার অফিস স্থাপিত হয় ভিক্টোরিয়া পার্কে অবস্থিত প্রভেনশিয়াল বুক ডিপো ভবনের দ্বিতীয় তলায়। দেশ স্বাধীনের পর গুলিস্তানে গুলিস্তান সিনেমা হল ভবনে প্রযোজনা সংস্থার অফিসগুলো একত্রিত হয়ে গড়ে তোলে ফিল্মপাড়া। ২০০০ সালের প্রথম দিকে গুলিস্তান সিনেমা হল ভেঙে ফেলা হলে প্রযোজনা সংস্থাগুলো কাকরাইলে চলে আসে। এখানে রাজমণি ভবন, ভূইয়া ম্যানশন, ফরিদপুর ম্যানশন, যমুনা ভবন, ইস্টার্ন কমার্শিয়াল ভবনে খোলা হয় প্রযোজনা সংস্থার অফিস। তখন থেকেই চলচ্চিত্রপাড়া হিসেবে খ্যাতি লাভ করে কাকরাইল। এই ফিল্মপাড়ায় শতাধিক চলচ্চিত্র প্রযোজনার অফিস এ শিল্পটিকে সরব
করে রেখেছিল। ২০০৭ সালের পর থেকে নানান কারণে চলচ্চিত্র ব্যবসায় মন্দাভাব শুরু হলে ধীরে ধীরে প্রযোজনা সংস্থা বন্ধ করে দিয়ে অফিস গুটিয়ে নিতে শুরু করেন প্রযোজকরা। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রধান কর্মকর্তা মিয়া আলাউদ্দীন উদ্বেগের সঙ্গে জানান, এখন এই ফিল্মপাড়ায় প্রযোজনা সংস্থার অফিস নেই বললেই চলে। কারণ চলচ্চিত্র নির্মাণই যদি না থাকে তাহলে অফিস ভাড়া, স্টাফ খরচসহ অন্যান্য ব্যয় আর কত লোকসান গুনে টিকিয়ে রাখা যায়। যেগুলো আছে তাতে চলচ্চিত্রের কোনো কাজ নেই। বাধ্য হয়ে অন্য ব্যবসায় অফিসগুলোকে ব্যবহার করছেন সংশ্লিষ্ট প্রযোজকরা। কাকরাইলের বাইরে বিভিন্ন স্থানে হাতে গোনা কয়েকটি প্রযোজনা সংস্থার অফিস রয়েছে। যেমন -জাজ মাল্টিমিডিয়া, এস কে ফিল্মস, লাইভ টেকনোলজি ইত্যাদি। এগুলো থেকেও এখন আর নিয়মিত ছবি পাওয়া যায় না। দীর্ঘদিন ধরে প্রযোজনায় অনিয়মিত রয়েছে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় প্রযোজনা সংস্থা জাজ মাল্টিমিডিয়া।
হার্টবিট প্রোডাকশন হাউসের কর্ণধার তাপসী ফারুক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সিনেমা হলে পরিবেশের অভাব, সিনেমা হল হ্রাস, অপর্যাপ্ত সিনেপ্লেক্স এবং দর্শক গ্রহণযোগ্য ও নায়ক-নায়িকার অভাবে ছবি এখন আর ব্যবসা সফল হয় না। একমাত্র শাকিব খানকে নিয়ে ছবি নির্মাণ করলে সেই ছবি ব্যবসার মুখ দেখে। কিন্তু এই নায়ক আকাশছোঁয়া পারিশ্রমিক দাবি করায় তাকে নিয়ে ছবি নির্মাণ করতে গেলে যে পরিমাণ অর্থের দরকার তা তুলে আনার মতো সিনেমা হল কোথায়।
সিনেমা হলের সংখ্যা এখন পঞ্চাশের নিচে নেমে আসায় এ অর্থ ফেরত কোনোভাবেই আনা সম্ভব নয়। ফলে প্রযোজনা সংস্থা টিকিয়ে রাখতে গেলে স্টাফদের বেতনসহ নানা ব্যয় নির্বাহ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। এতে প্রযোজনা সংস্থাগুলো এখন চরম অশনিসংকেতের কবলে পড়েছে। সরকারের কাছে প্রণোদনা নয়, সহজ শর্তে ঋণ চাই। তাহলে আবার মানসম্মত ছবি নির্মাণের মাধ্যমে এ শিল্পকে চাঙা করে তোলা সম্ভব হবে।