ঢাকাই চলচ্চিত্রে সংগীত জগতের ইতিহাসে কিছু গান থাকে, যেগুলো কেবল গান নয়-সময়, স্মৃতি আর অনুভবের এক অদৃশ্য সেতুবন্ধন। এমনই এক গান ‘সেই মেয়েটি আমাকে ভালোবাসে কি না আমি জানি না, যার মেঘকালো চুল, হরিণী চোখ...’। ‘মৌসুমী’ চলচ্চিত্রের এ গান যেন এক নিঃশব্দ ভালোবাসার স্বাক্ষর, আর এর অনবদ্য প্রাণ-আমাদের প্রিয় কণ্ঠশিল্পী খালিদ হাসান মিলু।
মৌসুমীর সঙ্গে মিলুর সুরের জাদু
নাজমুল হুদা মিন্টু পরিচালিত মৌসুমীর নামেই নির্মিত হয়েছিল এ ছবি। নায়িকার নামে ছবি সেভাবে হয়নি ঢালিউডে, মৌসুমী সে ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ এ ছবিতে। ছবির গল্প গতানুগতিক ত্রিভুজ প্রেমের হলেও গান ছিল কালজয়ী। ছবিতে মৌসুমীর বিপরীতে ছিলেন অমিত হাসান ও নাদিম হায়দার। আসলে নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে যখন ঢালিউডে মৌসুমী এক উজ্জ্বল তারার মতো আবির্ভূত হচ্ছেন, ঠিক সেই সময়েই মিলু নিজের কণ্ঠ দিয়ে সিনেমার গানে তৈরি করছিলেন নতুন এক ধারা। ‘মৌসুমী’ ছবিটি যেমন ছিল ব্যতিক্রমী নির্মাণ ভাবনায়, তেমনি এর গানগুলোও পেরিয়ে গেছে কালের সীমারেখা। বিশেষ করে ‘সেই মেয়েটি’ এবং ‘চারিদিকে শুধু তুমি’-এই দুই গান আজও প্রেমিক- প্রেমিকাদের কাছে আবেগের অনুবাদ। তবে ‘সেই মেয়েটি’ গানে মিলুর কণ্ঠ এমন এক নির্লিপ্ত আবেগে মিশে গিয়েছিল, যেন গানের প্রতিটি শব্দ প্রেমিকের কণ্ঠ ছুঁয়ে সরাসরি শ্রোতার হৃদয়ে প্রবেশ করে। সিনেমার দৃশ্যে মৌসুমীর চোখ, মিলুর কণ্ঠ আর গানের কথা-এই তিনের মিশ্রণে তৈরি হয়েছিল এক অনন্য রসায়ন, যা আজও মনে পড়লে সবাই শিউরে ওঠে।
যে কণ্ঠ ছুঁয়েছিল হৃদয়ে-পর্দায়
মিলুর কণ্ঠ ছিল জাদুকরি। তার গায়কিতে ছিল এক ধরনের মাধুর্য, যা একবার শুনলে হৃদয় এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। সে কণ্ঠের অনুরণনে কাঁপত পর্দার নায়কের ঠোঁট, আর কেঁপে উঠত পর্দার বাইরের শ্রোতাদের হৃদয়। তার গান ছিল এমন এক অনুভব, যেখানে প্রেম ছিল, ব্যথা ছিল, আর ছিল অপূর্ব এক আত্মসমর্পণ।
মিলুর গান মানেই প্রথম প্রেমের সঙ্গী
খালিদ হাসান মিলু ছিলেন এমন এক শিল্পী, যিনি শুধু গান গাইতেন না, গান বাঁচিয়ে তুলতেন। নব্বই দশকের ছেলেমেয়েদের প্রথম প্রেম, প্রথম চিঠি কিংবা প্রথম অভিমান-সবকিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তার গাওয়া কোনো না কোনো গান।
সময়ের আগেই হারিয়ে যাওয়া এক স্বর্ণকণ্ঠ
১৯৯৪ সালে দিলীপ সোমের ‘হৃদয় থেকে হৃদয়’ চলচ্চিত্রের জন্য মিলু শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, এমন এক শিল্পী আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন মাত্র ৪৫ বছর বয়সে। আজকের ডিজিটাল যুগে যখন সংগীত অনেকটাই মেশিনে বন্দি, তখন মিলুর মতো কণ্ঠশিল্পীর শূন্যতা আরও বেশি করে অনুভব করে ভক্তরা। তার গাওয়া গানগুলোর মধ্যে ‘প্রাণের চেয়ে প্রিয়’, ‘তুমি আমার হৃদয়ে যদি থাকো’, কিংবা ‘মায়ের একধার দুধের দাম’-এই গানগুলো আজও শ্রোতার ভালোবাসায় জীবন্ত।
পিতার স্মৃতি, সন্তানের উত্তরসূরিতা
প্রতীক হাসান ও প্রীতম হাসান আজ তার উত্তরসূরি হিসেবে সংগীতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করলেও খালিদ হাসান মিলুর উপস্থিতি এক অনন্য ছায়া হয়ে তাদের ওপর এখনো বিরাজমান। প্রতীক বাবাকে নিয়ে বলেন, ‘আব্বু ছিলেন স্বপ্নের মানুষ। আব্বুকে দেখেই মূলত গানের জগতে আমার স্বপ্ন দেখা শুরু। ছোট্ট থেকে আব্বুর গান গাওয়া আর সেই সঙ্গে তার জনপ্রিয়তা দেখে গানের প্রতি একটা আগ্রহ জন্মেছিল।’ অন্যদিকে প্রীতম হাসান বাবার স্মৃতি মনে করে বলেন, ‘আমার আব্বু সংগীতশিল্পী খালিদ হাসান মিলুর সঙ্গে খুব বেশি স্মৃতি নেই। আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, তখন আব্বু মারা যান। বাবা দেশের বিভিন্ন জায়গায় শো করতে যেতেন। এর ফাঁকে যতটুকু সময় পেতেন, ওই সময়ের মধ্যেই আমাদের নিয়ে বেড়াতে যেতেন। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় আব্বুর সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। তাঁর কালো পোশাক পরা ছবিটাই আমার চোখে ভাসে।’
শেষ গানে বেঁচে থাকা এক ভালোবাসা
আজ যখন ‘সেই মেয়েটি’ গানটা বাজে, আমরা শুধু গান শুনি না-আমরা এক বিশুদ্ধ সময়ে ফিরে যাই। যেখানে প্রেম ছিল নিঃস্বার্থ, গান ছিল হৃদয়স্পর্শী, আর কণ্ঠ ছিল খালিদ হাসান মিলুর মতো অমর শিল্পীর।