সম্প্রতি নিউইয়র্ক সিটির কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদেশে পলাতক আওয়ামী সমর্থকরা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী রাজনৈতিক নেতাদের ওপর হামলার অপচেষ্টা চালান। বাংলাদেশ মিশন ও প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী নিরাপত্তারক্ষীরা অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ও তার সফরসঙ্গীদের দ্রুত নিরাপদে বিমানবন্দর থেকে বের করে নিয়ে যান। তার সফরসঙ্গী বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ছয় রাজনৈতিক নেতাকে নিরাপত্তাহীন অবস্থায় সাধারণ টার্মিনাল এলাকায় ফেলে চলে যান। সেই সুযোগে পরিকল্পিতভাবে সমবেত আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রবাসীরা বাংলাদেশি ছয় রাজনৈতিক নেতার ওপর হামলার অপচেষ্টা চালান, ডিম ছুড়ে মারেন। এ ঘটনা বিশ্বের মানুষকে স্তম্ভিত করেছে। এজন্য দায়ী জাতিসংঘ মিশন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিতে পারতেন। তদন্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিতে পারতেন চূড়ান্ত পদক্ষেপ। কিন্তু সরকারের কেউ ঘটনাটি পাত্তাই দেয়নি। তারা একটা বিবৃতিতে দুঃখ প্রকাশ করে দায়িত্ব সেরেছে। এটা কিন্তু ক্ষমার অযোগ্য বিষয়।
দুর্ভাগ্যজনক নিউইয়র্কের বিমানবন্দরে বিপুলসংখ্যক বিএনপি কর্মী উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও তারা এই দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করতে পারেননি। এ ঘটনায় বাংলাদেশ জাতিসংঘ মিশন কর্মকর্তারা দায় এড়াতে পারেন না, তাদের এই দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের জন্য কঠোর শাস্তি হওয়া দরকার। ঘটনাটি মামুলি ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। দেড় হাজার বা আরও বেশি ছাত্র-যুবক, শিশু-কিশোর, পেশাজীবীর গণহত্যা ও প্রায় ২০ হাজার প্রতিবাদী নেতা-কর্মীকে গুলিতে আহত ও পঙ্গু বানিয়ে আওয়ামী মাফিয়া গোষ্ঠী এখন প্রতিবেশী ভারত এবং দুনিয়ার অন্য অনেক দেশে নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় গণতন্ত্রকামী সংগ্রামী মানুষের ভয়ংকর শত্রু হয়ে উঠেছে। তাদের নেত্রী শেখ হাসিনা তার আইনি বিচারে বাধা সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি হুমকি দিয়ে চলেছেন এই বিচার প্রক্রিয়ায় (আইসিটি বিচারের কর্মকাণ্ডে) যারাই অংশ নেবে তাদের বিরুদ্ধে তার আওয়ামী লীগ কর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়বে। যেখানে তিনি কোনো সভ্য মানুষ হলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারের মুখোমুখি হতে দেশে এসে কারাবন্দি হওয়ার কথা, তিনি তা না করে তার জুলাই গণহত্যার ও সাড়ে পনেরো বছরের রাষ্ট্র-ডাকাতির লাখ লাখ কোটি টাকা বিচারপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারীদের উল্টো হুমকি দিচ্ছেন বৈধ বিচারপ্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে। এতে শেখ হাসিনা নিজেকে প্রকৃত ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচার প্রমাণ করে ছাড়ছেন। দেশের মানুষের ভোটে নির্বাচনে জেতার ভান করে জনগণের ওপর গুলি চালালেন কীভাবে তিনি তার বর্বর বাহিনী দিয়ে? আজকে যদি শহীদ সন্তানের বাবা-মা শেখ হাসিনাকে প্রশ্ন করেন আমাদের সন্তানের জায়গায় যদি আপনার নিজের সন্তানরা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলিতে নিহত হতেন (আল্লাহতায়ালা মাফ করুন, এমনটা যেন কখনো না ঘটে কারও ক্ষেত্রে), মা হিসেবে তার কেমন লাগত? অথচ তিনি শহীদদের বাবা-মায়ের কাছে ক্ষমা না চেয়ে তাদের বিদ্রুপ করে যাচ্ছেন, হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি নিউইয়র্ক বিমানবন্দরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের ওপর এই হামলার নির্দেশদাতাও শেখ হাসিনা। তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। দেশের ভিতরে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী ছাত্রলীগ (সম্প্রতি নিষিদ্ধঘোষিত), যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ এসব সংগঠনের নেতা-কর্মী যারা ঝটিকা মিছিলের অপচেষ্টা চালান তারা কি প্রকৃত গণ আন্দোলনে বিশ্বাস করেন? তাহলে তাদের নেত্রীকে ভারতে পালিয়ে গিয়ে একটা কুখ্যাত সাম্প্রদায়িক, হিন্দুত্ববাদী চরম-অসাধু সরকারের আশ্রয়ে থাকতে হতো না। শেখ হাসিনার সাহস থাকলে গণতন্ত্র ভালোবাসলে, এ দেশের মানুষের রাজনীতির ওপর ভরসা রাখলে তিনি দেশে ফিরে কারাবন্দি থেকে আইসিটির বিচারের মুখোমুখি হতে পারতেন। আইসিটি ট্রায়ালে শেখ হাসিনার পক্ষে একজন শক্তিশালী উকিল দেওয়া হয়েছে। যিনি সোচ্চার কণ্ঠে শেখ হাসিনার পক্ষে যুক্তি দিয়ে মামলা লড়ে যাচ্ছেন।
এদিকে দেশবিদেশে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগের (যার কর্মকাণ্ড আইনিভাবে এখন নিষিদ্ধ) পুনর্বাসনের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন কিছু বুদ্ধিজীবী নামধারী সাংবাদিক। কিছু মিডিয়াব্যক্তিত্ব নিজেদের নির্বুদ্ধিতার কারণেই হোক আর মতলববাজির জন্য হোক আওয়ামী লীগকে বিচারের আগেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহ দেখাচ্ছেন, তারা দস্তুরমতো আওয়ামী মাফিয়া গোষ্ঠীর এজেন্ট হিসেবে মাঠে নেমেছেন।
আমরা স্মরণ করতে পারি, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫-এর ১৪ আগস্ট অবধি অগণন রাজনৈতিক হত্যাসহ সাধারণ নিরীহ মানুষ খুন হয়েছেন, গুম-খুন হয়েছেন, সম্পদ লুণ্ঠনের শিকার হয়েছেন ক্ষমতাধর আওয়ামী লীগ মাফিয়া-দানবদের দ্বারা। এসব অপরাধীর বিচার না হওয়াতে পরবর্তীকালে দানব-স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও তার সহযোগী খুনি, রাষ্ট্র-লুটেরা গোষ্ঠী বিশাল ভিত্তিভূমি পেয়েছে আরও গুরুতর অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার। স্বৈরশাসক এরশাদের ও তার সহযোগী অপরাধীদের বিচার করা যায়নি তার পতনের পরে। ফলে শেখ হাসিনা এত বড় ফ্যাসিস্ট দানব হয়ে ওঠার সাহস পেয়েছেন। এত বড় গণহত্যাকারী, রাষ্ট্র-লুটেরা ও সর্ব ধরনের অনাচার-অপরাধের দৈত্য-শাসক হতে উৎসাহিত হয়েছেন। এরশাদ হাসিনার ফ্যাসিবাদের প্রধান-গুরু এটা প্রমাণিত সত্য। তবে তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানও একধরনের নিষ্ঠুর স্বৈরশাসকে পরিণত হয়েছিলেন। গণতন্ত্র হত্যা করে একদলীয় বাকশাল ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিলেন।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের ভিত্তিভূমি তৈরি করেছে সাড়ে পনেরো বছরব্যাপী গণ আন্দোলনে বিএনপি রাজনীতির কর্মী-সংগঠক-নেতারা। প্রচণ্ড নিপীড়নে তারা সর্বস্বান্ত হয়েও থেমে যাননি। তাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনটি এত দ্রুত সাফল্যের পথে এগিয়ে যায়। ৩৬ দিনে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট মাফিয়া-গোষ্ঠী বিশ্বের নজিরবিহীন গণহত্যা চালিয়েছে রাজপথে। এর আগে তারা অন্তত সাত শ রাজনৈতিক কর্মীকে গুম-খুন করেছে। ছাত্র-জনতার দেড় হাজার (এখন অবধি ৮৩৪ জন শহীদের হিসাব মিলেছে। জাতিসংঘের হিসাবে ১৪০০ শহীদ বলা হচ্ছে) রাজপথে ফ্যাসিবাদী হাসিনার বাহিনী দ্বারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পাশাপাশি কমপক্ষে ২০ হাজার গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গু বা আংশিক পঙ্গু-দশার শিকার হয়েছেন। এত বড় মহাপাপ করেও শেখ হাসিনার মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই, উল্টো সে রাজপথের আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলেছেন প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়ে। তার নির্লজ্জতার, তার নিষ্ঠুরতার কোনো পরিমাপ চলে না, সীমাপরিসীমা নেই। ফ্যাসিবাদী প্রত্যেকের বিচার দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে, একজন ফ্যাসিস্ট, গণহত্যাকারী, ছাত্র-গণমানুষ খুনিকে ছাড় দেওয়া চলবে না। শহীদ পরিবারগুলোর বাবা-মা-স্বজনদের কাছে অঙ্গীকার এসব গণহত্যাকারীকে মাফ করার সুযোগই নেই।
আইসিটি দুই ট্রাইব্যুনালে (আরেকটির প্রস্তাবনা রয়েছে মাত্র) কোনোমতে খুবই ধীরগতিতে বিচার চলছে খুনি ও রাষ্ট্র-লুটেরাদের। অন্তত আরও কয়েকটি ট্রাইব্যুনাল দরকার ছিল। প্রয়োজন বিচারের সঙ্গে জড়িত সবার, বিশেষভাবে সাক্ষীদের কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা। তা না হলে ফ্যাসিস্ট খুনিদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে অনেকেই এগোবেন না। এই অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বিচারের আওয়াজ তোলেন মাঝেমধ্যে, কিন্তু তারা সমগ্র বিচারকাজটির ব্যাপকতা এবং তার আয়োজনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগের ব্যাপারে আদৌ সচেতন নন।
ইতোমধ্যে বিগত এক বছরে অন্তত পাঁচ শ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী নেতা গণহত্যাকারী রাষ্ট্র-লুটেরার বিচার সম্পন্ন করে ফেলা দরকার ছিল। তাহলে দেশবিদেশে যে হামলা চালাচ্ছে আওয়ামী স্বৈরাচারের দোসররা, শেখ হাসিনা যে হুমকি দিচ্ছেন গণতন্ত্রের আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের, তার সাহস পেতেন না। মোদ্দাকথা দ্রুততম সময়ে এই সরকারের আমলেই, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী নেতাদের অন্তত কয়েকজনের বিচার সম্পাদন দরকার, তারপর তার চলমান প্রক্রিয়া আরও জোরদার করা দরকার। সেটাই হোক অন্তর্বর্তী সরকার তথা সামনের নির্বাচিত সরকারের প্রধান অঙ্গীকার শহীদদের পরিবারগুলোর কাছে, আহত ও পঙ্গু মানুষগুলোর কাছে, তাদের সবার স্বজনদের কাছে।
লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক