মঙ্গলবার, ৪ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

পবিত্র ঈদুল ফিতরের করণীয় ও শিক্ষা

মুফতি মাওলানা মুহাম্মাদ এহছানুল হক মুজাদ্দেদী

পবিত্র ঈদুল ফিতরের করণীয় ও শিক্ষা

হজরত আনাস বিন মালিক (রা.) বলেন, প্রতি বছর মুশরিকদের জন্য দুটি দিন ছিল সেদিন তারা আনন্দ-উৎসব করত। রসুল (সা.) যখন মদিনায় আসেন তখন তিনি বলেন, তোমাদের ওই দুটি উৎসবের চেয়ে আরও উত্তম দুটি আনন্দের দিন দেওয়া হলো। ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা। (সুনানে নাসায়ি : ১ম খ-, পৃ. ১৭৭; সুনানে আবু দাউদ ১ম খ-, পৃ. ১৬১)।

‘ঈদুল ফিতর’ শব্দ দুটি আরবি, যার অর্থ হচ্ছে উৎসব, আনন্দ, খুশি, রোজা ভেঙে ফেলা ইত্যাদি। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা ও ইবাদত-বন্দেগির পর বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ শাওয়াল মাসের চাঁদের আগমনে রোজা ভেঙে আল্লাহর বিশেষ শোকরিয়াস্বরূপ যে আনন্দ-উৎসব পালন করেন- শরিয়তের পরিভাষায় তাই ঈদুল ফিতর।

ঈদুল ফিতর সারা বিশ্বের মুসলমানের সার্বজনীন আনন্দ-উৎসব। নানা প্রতিকূলতা, দুঃখ-বেদনা সব ভুলে ঈদের দিন মানুষ সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হন। ঈদগাহে কোলাকুলি সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধনে সবাইকে নতুন করে আবদ্ধ করে। ঈদ এমন এক নির্মল আনন্দের আয়োজন, যেখানে মানুষ আত্মশুদ্ধির আনন্দে পরস্পরে প্রেমের বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হন এবং সালাম, মুসাফাহা, মুয়ানাকারর মাধ্যমে আনন্দ ভাগাভাগি করেন। মাহে রমজানের এক মাসের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নিজেদের অতীত জীবনের সব পাপ থেকে মুক্ত হতে পারার পবিত্র অনুভূতি ধারণ করেই পরিপূর্ণতা লাভ করে ঈদুল ফিতরের খুশি।

রমজান মাসের শেষ দিন সূর্যাস্তের পর অর্থাৎ ঈদের রাত থেকে শুরু করে ঈদের সালাত আদায় পর্যন্ত তাকবির পাঠ করা। তাকবিরের শব্দগুলো হচ্ছে, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লাইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ। পুরুষের জন্য উচ্চ স্বরে তাকবির বলা সুন্নত। মহিলারা নিঃশব্দে তাকবির বলবেন। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা ২য় খ-, পৃ. ১৬৫।)

নামাজের জন্য ঈদগাহের দিকে রওয়ানা হওয়ার আগে ৩টি, ৫টি এরকম বেজোড় সংখ্যক খেজুর খাওয়া সুন্নত। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন, প্রিয়নবী (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন সকালে বেজোড়সংখ্যক খেজুর খেতেন। (আদ-দুরূসুর রামাদানিয়াহ, পৃ. ১৮৫।)

পুরুষের জন্য সুন্নত হলো গোসল করে, সুন্দর পোশাক পরিধান করে, সুগন্ধি মেখে, সুসজ্জিত হয়ে ঈদগাহ অভিমুখে রওনা হওয়া। মহিলারা নিজেদের মহলে সুসজ্জিত হয়ে, সুগন্ধি মেখে আনন্দ-উৎসব করবেন। সৌন্দর্য প্রদর্শনীর জন্য হওয়া হারাম। বরং তারা পর্দা করে বের হবেন। এ সম্পর্কে রসুল (সা.) বলেন ‘কারও যদি নিজেকে ঢাকার চাদর না থাকে তার অন্য বোন যেন তাকে নিজের অতিরিক্ত চাদরটি দেয়’। (মুখতার লিল হাদিস, পৃ. ৪৪১)।

ঈদের মাঠে পায়ে হেঁটে যাওয়া এবং ভিন্ন পথে ফিরে আসা সুন্নত। হজরত জাবির (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) ঈদের দিন এক পথে ঈদগাহে যেতেন, অন্য পথে বাড়ি ফিরতেন। ফিতনার আশঙ্কা না থাকলে মা-বোনদেরও ঈদগাহে যাওয়া উত্তম। (ফিকহে মানহাজী, ১ম খ-, পৃ. ২২৮।)

ঈদুল ফিতরের দিনে অন্যতম প্রধান করণীয় হচ্ছে ফিতরা প্রদান করা। নর-নারী, ছোট-বড়, স্বাধীন-গোলাম সবার ওপর ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। (বুখারি ও মুসলিম)।

এদিন মেহমানদারি করা, দান সদকা করা। সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা উত্তম। হজরত যুবায়ের ইবনে নুফায়র থেকে বর্ণিত। রসুল (সা.) এর সাহাবিগণ যখন ঈদের দিনে দেখা করতেন তখন একে অপরকে বলতেন, ‘তাকাব্বাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা।’ (ফাতহুল বারী ২য় খ-, পৃ. ৪৪৬।)

মুসলিম মিল্লাত নানা দল ও বিভিন্ন মতে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে পারস্পরিক মায়া-মমতা ও ভালোবাসা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে পারস্পরিক ঘৃণা, হিংসা-বিদ্বেষ ও কলহ-বিবাদ। ঈদুল ফিতর যাবতীয় হিংসা-দ্বেষ ও কলহ-বিবাদ ভুলে গিয়ে ঐক্য ও সংহতির বন্ধন সুদৃঢ় করতে শিক্ষা দেয়। সবাই দল ও মত নির্বিশেষে ঈদগাহে সমবেত হয়। একই কাতারে দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঈদুল ফিতরের ওয়াজিব সালাত আদায় করেন। ঈদের সালাতের এই মহামিলন থেকে মুসলমানগণ ‘একই উম্মাহ’ হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শিক্ষা লাভ করে থাকেন। ঈদগাহে মহামিলনের মধ্য দিয়ে আল্লাহ ও রসুল (সা.) এর প্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়াই ঈদুল ফিতরের অন্যতম প্রধান শিক্ষা।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি, প্রত্যেক মুসলিমকে ঈদুল ফিতরের এ দিনটির মতো বছরের প্রতিটি দিন নেক আমল এবং হাশিখুশির মাধ্যমে অতিবাহিত করার চেষ্টা করা উচিত। এ দিনের মতোই সারা বছর তাকওয়ার জীবনযাপনের অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়া উচিত। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব, তাৎপর্য, শিক্ষা অনুধাবন করে সে মোতাবেক আমল করার তৌফিক দান করুন। ঈদ আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বময়।

লেখক : এম ফিল গবেষক, মুফাসসিরে কোরআন, বেতার ও টিভির ইসলামী উপস্থাপক; খতিব, মণিপুর বাইতুর রওশন (মাইকওয়ালা) জামে মসজিদ, মিরপুর, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর