ভূমিকম্পে বারবার কেঁপে উঠছে সিলেট। কখনো সীমান্তের ওপারে ভারতের মেঘালয়ের ডাউকি ফল্ট, আবার কখনো উৎপত্তিস্থল সিলেট বিভাগের ভেতর। আবার কখনও রাজধানীর শহর ঢাকার কেন্দ্রবিন্দু। পর্যায়ক্রমে কম্পিত হওয়া একের পর এক ভূমিকম্পে আতঙ্কে দিন কাটছে সিলেট নগরবাসীর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকা স্থানীয় ফল্টগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠায় ভূমিকম্পের হার দ্রুত বাড়ছে। ভূতাত্ত্বিকভাবে ‘ডেঞ্জার জোন’-এ থাকা সিলেটে তাই বড় ধরনের দুর্যোগের ঝুঁকি ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সিলেট নগরীতে যমদূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ পুরনো ভবনগুলো বড় ধরনের আতঙ্ক তৈরি করেছে। বড় ভূমিকম্প হলে এসব ভবন ধসে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটতে পারে বলে সতর্ক করেছেন নগরবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তবুও এতদিন সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো উদাসীনই ছিল। তবে এবার নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম জানিয়েছেন, ‘সিলেট নগরীর ২৩টি বিপজ্জনক ভবন ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেগুলো খুব শীঘ্রই ভেঙে ফেলা হবে। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি ভবন রয়েছে। আগামী সপ্তাহ থেকেই অপসারণের কাজ শুরু হবে।’
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, নগরীর অধিকাংশ পুরনো ভবনের নকশায় ভূমিকম্প প্রতিরোধী ব্যবস্থা নেই। তীব্র কম্পনে এগুলোতেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা। ঝুঁকির মধ্যে থাকা ভবনগুলোর মাঝে রয়েছে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক মার্কেট ও আবাসিক ভবন।
এদিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় তিন দফা ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় সিলেট ও আশপাশের জেলার মানুষের আতঙ্ক আরও বেড়েছে। শনিবার (২২ নভেম্বর) সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিটে এক সেকেন্ড ব্যবধানে দুটি ভূমিকম্প হয়—প্রথমটি ৩.৭ এবং পরেরটি ৪.৩ মাত্রার। একই দিন সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে ৩.৩ মাত্রার আরেকটি ভূকম্পন অনুভূত হয়। এর আগের দিন শুক্রবার (২১ নভেম্বর) ৫.৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে দুই শিশুসহ ১০ জনের মৃত্যু হয়, আহত হয় কয়েকশ মানুষ।
জেলা প্রশাসক সারওয়ার আলম বলেন, ‘সিলেট নগরীর ২৩টি বিপজ্জনক ভবন ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেগুলো খুব শীঘ্রই ভেঙে ফেলা হবে। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি ভবন রয়েছে। আগামী সপ্তাহ থেকেই অপসারণের কাজ শুরু হবে। চিহ্নিত ভবনগুলোতে এখনো কেউ কেউ বসবাস করছে বা কাজ করছে। দ্রুত অপসারণ না করলে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। নাগরিকদের সুরক্ষার জন্যই আমরা জরুরি ভিত্তিতে ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রশাসন ইতোমধ্যে একাধিক ওয়ার্কশপ করেছে। তবে উদ্ধারকাজে প্রধান সমস্যা হচ্ছে সংকীর্ণ রাস্তা-ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করতে না পারলে রেসকিউ কার্যক্রম ব্যাহত হবে।’
উল্লেখ্য, এর আগে ২০১৯ সালে সিসিক নগরীর ২৪টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করেছিল। এর মধ্যে ৬টি সংস্কারের মাধ্যমে ঝুঁকিমুক্ত করা হলেও ১৮টি ভবন এখনো বিপজ্জনক অবস্থায় রয়ে গেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে—সমবায় ব্যাংক ভবন মার্কেট, মধুবন মার্কেট, সুরমা মার্কেট, মিতালী ম্যানশন, রাজা ম্যানশন, নবপুষ্প-২৬/এ, আজমীর হোটেলসহ আরও বেশ কিছু আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। এ ছাড়া পূর্বের তালিকা থেকে কিছু ভবন ইতোমধ্যে অপসারণ বা সংস্কার করা হয়েছে-যেমন কালেক্টরেট ভবন-৩, বন্দরবাজার সিটি সুপার মার্কেটের ঝুঁকিপূর্ণ অংশ, কিবরিয়া লজ, বনকলাপাড়ার নূরানী-১৪, ধোপাদিঘীর পাড়ের পৌর শপিং সেন্টার ইত্যাদি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোতে বড় বড় ফাটল, নড়বড়ে সিঁড়ি, হেলে পড়া দেয়াল। এই সব মিলিয়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন বাসিন্দারা। ২০২৩ থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত সিলেট বিভাগে অনুভূত একাধিক ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেট বিভাগ ও পার্শ্ববর্তী মেঘালয়; যা ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা জাগাচ্ছে।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন